বিশ্বব্যাপী টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সামুদ্রিক যোগাযোগ ও বাণিজ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, কিন্তু এই বিপুল সম্ভাবনা এখনো অনেকটাই অব্যবহৃত রয়ে গেছে। তিনি ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোকে তাদের উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সমুদ্র কূটনীতি জোরালো করার ওপর জোর দেন।
রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে শুক্রবার ষষ্ঠ ইন্ডিয়ান ওশান কনফারেন্সের উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে, সাগর-মহাসাগরসমূহের মাধ্যমে বিশ্ববাণিজ্যের ৯০ শতাংশ ও তেল পরিবহনের ৬০ শতাংশ পরিচালিত হচ্ছে। সমুদ্রপথে প্রকৃত বাণিজ্য বিগত ১৫ বছরে তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
সম্মেলনের সর্বাঙ্গীণ সফলতা কামনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এবং আফ্রিকার অঞ্চলসমূহে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং কৌশলগত উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব রয়েছে। বর্তমানে বৈশ্বিক জনসংখ্যার ৬৪ শতাংশ এ অঞ্চলে বাস করে এবং জিডিপিতে এ অঞ্চলের অবদান ৬০ শতাংশ। বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও, এ অঞ্চলটি নানাবিধ প্রতিকূলতার মুখোমুখি হচ্ছে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের শান্তি এবং সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে অংশীদারত্ব এবং সহযোগিতা বৃদ্ধি করা আবশ্যক।
শেখ হাসিনা বলেন, এবারের এই সম্মেলনের প্রতিপাদ্য টেকসই ভবিষ্যতের জন্য শান্তি, অংশীদারত্ব এবং সমৃদ্ধি অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং যথাযথ হয়েছে। টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিতকরণে অংশীদারত্ব, শান্তি ও সমৃদ্ধির মধ্যে সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। সাম্প্রতিক সময়ে কোভিড-১৯ মহামারি এবং চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা এবং পাল্টা নিষেধাজ্ঞা বিশ্বব্যাপী অনেক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, যার প্রেক্ষাপটে আজকের এ সম্মেলনের প্রতিপাদ্য আরও বেশি প্রাসঙ্গিক বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
তিনি বলেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, খাদ্য, জ্বালানি এবং সার-সংকটের ফলে বিশ্বজুড়ে মানুষের জীবনযাত্রা অসহনীয় হয়ে পড়েছে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলকেও জলবায়ু পরিবর্তন, সামুদ্রিক নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এ সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠার জন্য এ অঞ্চলের দেশগুলোকে অংশীদারত্ব এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপর জোর দিতে হবে।
সরকারপ্রধান বলেন, নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমরা ১.১ মিলিয়নেরও বেশি জোরপূর্বক বাস্তচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের বাংলাদেশে অস্থায়ীভাবে আশ্ৰয় দিয়েছি, যার ফলে এ অঞ্চলে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। এখন আমরা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের মাতৃভূমিতে প্রত্যাবাসন নিশ্চিতকরণে বিশ্বসম্প্রদায়ের সক্রিয় সমর্থন কামনা করি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটি উপকূলীয় রাষ্ট্র হিসেবে বহু শতাব্দী ধরে বাংলাদেশ বিভিন্ন সামুদ্রিক কার্যকলাপের প্রাণকেন্দ্র। বাংলাদেশ সমুদ্রবিষয়ক অনেক আঞ্চলিক প্ল্যাটফর্মে সক্রিয় রয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশন এবং কাউন্সিল অব দ্য ইন্টারন্যাশনাল সিবেড অথরিটির সভাপতি। গত এক দশকে বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের চরম দারিদ্র্যের হার ৫.৬ শতাংশে নেমে এসেছে এবং আমাদের মাথাপিছু আয় গত এক দশকে তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২ হাজার ৮২৪ ডলার হয়েছে। উপরন্তু বাংলাদেশ ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় সব মানদণ্ড পূরণ করেছে।
তিনি বলেন, আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখি যেখানে শক্তিশালী ভৌত অবকাঠামো আমাদের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির সহায়ক হবে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভারত মহাসাগর শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, এই অঞ্চলের সব দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা আমাদের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল তৈরি করেছি।
ষষ্ঠ ইন্ডিয়ান ওশান কনফারেন্সে ভারত মহাসাগর অঞ্চলের জন্য ৬টি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেন প্রধানমন্ত্রী। যার মধ্যে রয়েছে: ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোকে তাদের উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সমুদ্র কূটনীতি জোরালো করতে হবে। এই অঞ্চলের অনেক দেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবের ঝুঁকিতে থাকার বিষয়টি বিবেচনা করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং তদসংশ্লিষ্ট ক্ষয়ক্ষতি কমাতে আমাদের সহযোগিতা বাড়াতে হবে। একটি স্থিতিশীল এবং টেকসই ভবিষ্যতের জন্য ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস এবং সমীহর ভিত্তিতে শক্তিশালী অংশীদারত্ব গড়ে তুলতে হবে। ভারত মহাসাগরে সামুদ্রিক নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিদ্যমান ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা, যার মধ্যে সমুদ্রে জরুরি পরিস্থিতিতে সাড়া দেয়া, অনুসন্ধান ও উদ্ধারকাজে সহায়তা এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে নৌ ও বিমান চলাচল নিশ্চিত করা হবে। শান্তির সংস্কৃতি চর্চা এবং জনবান্ধব উন্নয়নের প্রসার করতে হবে। একটি শান্তিপূর্ণ, সমতাভিত্তিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের উদ্দেশ্যে বিশ্ব জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারীসম্প্রদায়কে যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। উন্মুক্ত, স্বচ্ছ, নিয়মভিত্তিক বহুপক্ষীয় ব্যবস্থার প্রসার করা, যা অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে এই অঞ্চলে এবং তার বাইরে সমতাভিত্তিক টেকসই উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে।