সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হবে ২১ জুন। এই নির্বাচন ঘিরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ দৃশ্যত ঐক্যবদ্ধ। নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষে মাঠে আছেন দলের সবাই। মনোনয়ন নিয়ে প্রথম দিকে কিছু ক্ষোভ থাকলেও প্রকাশ্যে এখন কোনো বিভাজন নেই। ক্ষমতাসীন দলটি তবু স্বস্তিতে নেই।
আওয়ামী লীগে এমন ঐক্য সবশেষ ২০১৮ সালের সিলেট সিটি নির্বাচনেও ছিল। তবু নির্বাচনে পরাজিত হন দলটির প্রার্থী সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। দলের অনেক নেতার অসহযোগিতার কারণেই কামরানকে হারতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। গত সিটি নির্বাচনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে এবারও স্থানীয় আওয়ামী লীগে আতঙ্ক রয়েছে।
প্রকাশ্য এমন ঐক্য নিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরে, বিশেষত কর্মীদের মধ্যে শুরু থেকেই একটা কানাঘুষা ছিলো। তবে সেই কানাঘুষা ছিল ভেতরে ভেতরে। বিষয়টি প্রথম প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক।
নৌকার প্রার্থী মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর সমর্থনে ৪ মে নগরীতে কর্মী সমাবেশের আয়োজন করে সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ।
সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে নানক আগের নির্বাচনে কামরানের পরাজয়ের প্রসঙ্গটি তুলে আনেন। নেতাকর্মীদের সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, ‘দলে খন্দকার মোশতাকের অনুসারী যেমন রয়েছে, তেমনি মুজিব আদর্শের লড়াকু এবং ত্যাগী কর্মীরাও রয়েছেন। মোস্তাক বাহিনীর কারণেই বিগত দিনে এই নগরের অভিভাবক বদর উদ্দিন আহমদ কামরানকে হারতে হয়েছে। এবার তার পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না আওয়ামী লীগ।’
বৃহস্পতিবার সিলেট নগরের এক কনভেনশন সেন্টারে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের কর্মিসভায় নৌকার প্রার্থীসহ দলীয় নেতৃবৃন্দ। ফাইল ছবি
রংপুর সিটি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পরাজয়ের পর জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি বাতিল করা হয়েছিল। সে বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়ে নানক বলেন, দলের প্রতিটি ওয়ার্ডে সভাপতি ও সম্পাদকের ভোটকেন্দ্রগুলোতে সজাগ দৃষ্টি থাকবে আওয়ামী লীগের। তাদের ভোটকেন্দ্রের ফল অনুযায়ী পুরস্কার ও তিরষ্কারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এমন কোনো কর্মকাণ্ড করবেন না যাতে করে রংপুরের পরিণতি ভোগ করতে হয়।’
নানকের ওই বক্তব্যের পর সিলেটে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধের বিষয়টি নিয়ে জোরেশোরে আলোচনা চলছে। নানকের কথিত ‘খন্দকার মোশতাক’দের কারণে এবারও গত নির্বাচনের পুনরাবৃত্তির শঙ্কাও করছেন অনেকে।
আবার নানকের এমন বক্তব্যে দলের শীর্ষ পর্যায়ের কিছু নেতা নাখোশ হয়েছেন বলেও জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের দুটি অঙ্গ সংগঠনের শীর্ষ দুই নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শাস্তির ভয়ে প্রকাশ্যে সবাই এক্যবদ্ধ থাকলেও দলের ভেতরে একটি অংশ দলীয় প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামানের ব্যাপারে ততোটা আন্তরিক নয়। কেউ কেউ ভেতরে ভেতরে ষড়যন্ত্রও করছেন। তাদের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় নেতাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। তাদের কড়া নজরদারিতে রাখতে হবে। নইলে গতবারের পরিণতি হতে পারে।
তবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও শীর্ষ নেতারা বলছেন, গতবারের পুনরাবৃত্তি হবে না। এবার দল পুরোপুরি ঐক্যবদ্ধ।
গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী প্রয়াত বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের ছেলে ও সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আরমান আহমদ শিপলু এবারের প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির মিডিয়া উপ-কমিটির দায়িত্বে রয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে শিপলু বুধবার বলেন, ‘প্রকাশ্যে দলের মধ্যে আমরা ঐক্য দেখতে পাচ্ছি। সবাই নৌকার বিজয়ের লক্ষ্যে কাজ করছেন। তবে গতবারের একটা দুঃখবোধ তো থেকেই যায়। গত নির্বাচনে আমাদের হারতে হয়েছিল। আশা করি এবার আর তার পুনরাবৃত্তি হবে না।’
সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান ছিলেন সিলেটের অন্যতম জনপ্রিয় নেতা। গত সিটি নির্বাচনের সময় মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতিও ছিলেন তিনি। তবু সবশেষ দুটি নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে হারতে হয় তাকে।
আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণেই ২০১৮ সালে কামরানকে হারতে হয় বলে অভিযোগ ওঠে। এমন অভিযোগ আমলে নিয়ে নির্বাচনের পরপর কামরানসহ দলের শীর্ষস্থানীয় চার নেতাকে শো-কজ করে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি।
আওয়ামী লীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, কেন্দ্রীয় সদস্য ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরান, সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন এবং তৎকালীন সিলেট মহানগরের ও বর্তমানে কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম নাদেলকে শো-কজ করা হয়।
এবারও দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন মিসবাহ উদ্দিন সিরাজসহ মোট ১১ নেতা। মনোনয়নপ্রত্যাশী অন্যরা হলেন- যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আসাদ উদ্দিন আহমদ ও আবদুল খালিক, সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেন, মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এ টি এম এ হাসান জেবুল ও আজাদুর রহমান আজাদ, সাংগঠনিক সম্পাদক আরমান আহমদ শিপলু ও ছালেহ আহমদ সেলিম, সদস্য প্রিন্স সদরুজ্জামান চৌধুরী এবং ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য মো. মাহি উদ্দিন আহমদ সেলিম।
তবে দল থেকে মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে মনোনয়ন দেয়া হয়। স্থানীয় নেতাদের বাদ দিয়ে প্রবাসী একজনকে দলীয় মনোনয়ন দেয়ায় সিলেট আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশের নেতারাই ক্ষুব্ধ। এই ক্ষোভ নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে- এমন আশঙ্কা ক্ষমতাসীন দলটির স্থানীয় নেতাকর্মীদের অনেকের। যদিও কেউ প্রকাশ্যে ক্ষোভের কথা প্রকাশ করতে চাননি।
মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ বলেন, ‘এবার আমি মনোনয়ন চেয়েছিলাম। তবে দলের একজন কর্মী হিসেবে শেখ হাসিনা ও নৌকার ব্যাপারে কোনো আপোস নেই। এখন প্রার্থী মুখ্য নয়, নৌকাকে জেতাতে আমরা ঐক্যবদ্ধ।’
এবারের সিটি নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না। তবে বিএনপি নেতা ও বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধরী অংশ নিতে পারেন বলে গুঞ্জন রয়েছে।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, আরিফুল হক প্রার্থী না হলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অনেকটা সহজেই জিতে যাবেন। তবে আরিফ প্রার্থী হলে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়তে হবে তাকে। নতুন প্রার্থী হওয়ায় কিছুটা পিছিয়েই রয়েছেন তিনি। ফলে দলের ঐক্য ছাড়া আনোয়ারুজ্জামানের পক্ষে তখন জয় পাওয়া কঠিন হবে।
দলের সবাই ঐক্যবদ্ধ বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের যারা মনোনয়ন চেয়েছিলেন তারা সবাই যোগ্য। তবে দল আমাকে মনোনয়ন দিয়েছে। এখন সবাই আমার সঙ্গে আছেন। নৌকার বিজয়ে তারা আন্তরিকভাবে কাজ করছেন।’
দলীয় ঐক্যের কথা জানিয়েছেন সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদও। তিনি বলেন, ‘মনোনয়ন না পেয়ে কেউ কেউ একটু মনঃক্ষুণ্ন হয়েছিলেন। তবে এখন আর তেমন কিছু নেই। এখন সবাই এক হয়ে দলীয় প্রার্থীর বিজয়ে কাজ করছেন।’
নির্বাচনী তফসিল অনুযায়ী, ২১ জুন সিলেট সিটি করপোরেশনে ইভিএমে ভোট হবে। ২৩ মে পর্যন্ত মনোনয়নপত্র দাখিল করা যাবে। মনোনয়নপত্র বাছাই হবে ২৫ মে আর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ১ জুন।