মাসে ১০ হাজার টাকা করে চাঁদা দাবি করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা। চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় ২ দিনে ১৫ হাজার টাকার খাবার খেয়ে বিল পরিশোধ না করার অভিযোগ উঠেছে। হোটেলে ঢুকে জোর করে খাবার খাওয়া সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
অভিযুক্তদের সবার পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় তাদের সবাই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ছিলেন কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ওই দোকানের কর্মচারীরা ছবি দেখে ওই কাজে নেতৃত্ব দেয়া কয়েকজনকে শনাক্ত করেছেন, যাদের তিনজনই ছাত্রলীগের নেতা।
শনাক্ত হওয়া ওই তিনজন হলেন- ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সহ-সম্পাদক আরিফুল ইসলাম, বিজয় একাত্তর হল ছাত্রলীগের গণযোগাযোগ ও উন্নয়ন বিষয়ক উপ-সম্পাদক সাকিবুল সুজন এবং স্যার এ এফ রহমান হল ছাত্রলীগের গ্রন্থনা ও প্রকাশনা বিষয়ক উপ-সম্পাদক সিফাত আহমেদ।
সাকিবুল সুজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের এবং সিফাত আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
আরেক অভিযুক্ত আরিফুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়নের একান্ত ঘনিষ্ঠজন হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত।
হোটেল মালিক পক্ষ বলছে, অভিযুক্ত এই তিনজনের মধ্যে আরিফুল ইসলাম ও সাকিবুল সুজন এই ঘটনায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দোকানের কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৫ মে শুক্রবার সন্ধ্যায় কয়েক ব্যক্তি এসে হোটেলের ম্যানেজার ইলিয়াস হোসেনকে বলেন, ‘এখানে হোটেল ব্যবসা করতে হলে আমাদেরকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা দিতে হবে।’
হোটেল ম্যানেজার টাকা দিতে অক্ষমতা প্রকাশ করলে তারা হুমকি-ধমকি দিয়ে চলে যান। যাওয়ার সময় টাকার ব্যবস্থা করে যোগাযোগের জন্য একজন তার মোবাইল নম্বর দিয়ে যান। পরে জানা যায়, ওই মোবাইল নম্বরটি ছাত্রলীগ নেতা সাকিবুল সুজনের।
মালিক পক্ষের দাবি, বিষয়টি নিয়ে একই দিন রাতে তারা সাকিবুল সুজন ও সিফাতের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির ডাস চত্বরে বসেন। তারা চাঁদা দাবির বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতকে জানাতে চাইলে সাকিবুল সুজন বলেন যে তার ভুল হয়ে গেছে। ওই সময় সেখানে বিভিন্ন হল পর্যায়ের আরও দুইজন নেতা উপস্থিত ছিলেন। তারা অভিযুক্তদের ক্ষমা করে দিতে বলেন।
হোটেলের কর্মচারীরা জানান, ৬ মে সন্ধ্যায় ১৮ থেকে ২০ জন তাদের হোটেলে আসেন। তারা সবাই ইচ্ছেমতো পরোটা আর গরুর বট খান। বিল আসে চার হাজার টাকা। খাওয়া শেষে তারা চলে যাওয়ার সময় বিল পরিশোধের কথা বললে তারা বলেন- সব টাকা আরিফ (আরিফুল ইসলাম) ভাই দেবেন।
হোটেলের কর্মচারী খোকন বলেন, ‘আমরা তো কোনো আরিফ ভাইকে চিনি না। এ বিষয়ে তাদেরকে আমরা জিজ্ঞাসাও করিনি। কারণ জিজ্ঞাসা করলেই মারবে এমন অবস্থা। এরপর ৭ মে আসেন ২৫জন। এদিনও প্রত্যেকে কয়েক প্লেট করে মাংস নিছে। তারা চাইছে আমরা দিছি। না দিলে তো আমাদের মারত।
‘তাদের খাওয়া শেষে দেখি শাহবাগ থানা পুলিশের একজন দারোগা (এসআই শাহরিয়ার জীবন)। এর কিছুক্ষণ পর হোটেলে আসেন তাদের সেই আরিফ ভাই আর সাকিবুল সুজন। তখন আরিফ ভাই আমাদের হোটেল বন্ধ করে রাখতে বলেন।
‘আরিফ ভাই এও বলে যান, তাদের সঙ্গে কথা না বলে যেন আমরা হোটেল না খুলি। আর টাকা না দিলে আমাদের দোকান মালিক কবির ভাইকে তুলে নিয়ে যাবেন বলেও হুমকি দেন তিনি। একইসঙ্গে তিনি বলে যান, মাসে ১০ হাজার টাকা না দিলে পরিস্থিতি মাঝেমধ্যেই এমন হবে।’
এই কর্মচারী আরও বলেন, ‘সে সময় শাহবাগ থানার দারোগা আরিফ ভাইকে বলেন, দোকান বন্ধ রাখবে কেন ভাই? দোকান চলুক। তখন সেই আরিফ ভাই বলেন, এই ছেলেরা যদি কালকে এসে আবার ঝামেলা করে সেই দায়দায়িত্ব আপনি নেবেন?
‘এ সময় এসব আলোচনা একজন ভিডিও করলে তাকে মারধর করে তার ভিডিও ডিলিট করে পুলিশের হাতে তুলে দেন ওই আরিফ ভাই। একইসঙ্গে বলেন, তাকে যেন থানায় আটকে রাখা হয়। এরপর আমরা বিস্তারিত আমাদের মালিক কবির ভাইকে জানিয়েছি। তিনি যার কাছ থেকে দোকান ভাড়া নিয়েছেন তাকে জানিয়েছেন। আর তিনিই ছাত্রলীগের সঙ্গে আলোচনা করে ঝামেলা মেটানোর চেষ্টা করছেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন বলেন, অভিযোগ আসার পর সত্যতা জানতে কয়েকজনকে সেখানে পাঠিয়েছিলাম। তারা আমাকে জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ওই দোকানের কর্মচারীদের একটা ঝামেলা হয়েছে। তবে এই ঘটনায় আরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে চাঁদা দাবির যে অভিযোগ উঠেছে সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
ঘটনার সময় উপস্থিত এসআই শাহরিয়ার জীবন বলেন, ‘ছাত্ররা দোকানের কর্মচারীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছে। পরে তারা দোকান বন্ধ করে দিতে চাইছে। আর ভিডিও করায় একজনকে মেরে তাকে ভয় দেখাতে আমার হাতে তুলে দেয়া হয়। অবশ্য আমি তাকে ছেড়ে দিয়েছি।’
দোকানের কর্মচারী খোকন বলেন, ‘এই ঘটনার পর আমরা আতঙ্কের মধ্যে আছি- কোন সময় তারা আবার চলে আসে। তবে ঘটনার সময় আমাদের হোটেলে কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল না। আমরা আজকে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়েছি।’
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শাহবাগ থানায় লিখিত অভিযোগ দেবে বলে জানায় মালিক পক্ষ।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমি কাউকে কোনো দোকান বন্ধ রাখতে বলা বা চাঁদা দাবি করিনি। সেদিন কয়েকজন ছোট ভাই এসে আমাকে বলে, এই হোটেলে খাবার খেয়ে তাদের পেট খারাপ করেছে। পরে আমি তাদেরকে ঝামেলা না করে চলে যেতে বলি। এতোটুকুই। আর কিছু হয়নি। বাকি যা বলা হচ্ছে সব মিথ্যা-বানোয়াট।’
আর কোনো কথা জিজ্ঞাসা করার সুযোগ না দিয়ে তিনি ফোন কেটে দেন। পরে আরও কয়েকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
আরেক অভিযুক্ত সাকিবুল সুজনও চাঁদা দাবির অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমার ফোন নম্বর কে দিয়ে আসছে আমি জানি না। আমি সেখানে ছিলাম না। আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে। আমি সম্প্রতি এই কবির হোটেলে যাইনি।
‘আর ডাস চত্বরে আমাদের সঙ্গে সিনিয়ররা বসেছিলেন। সেখানেও আমি বলেছি, এই ঘটনায় আমি জড়িত নই।’
অন্য অভিযুক্ত সিফাতও ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘কিছুদিন আগে আমি আর আমার বন্ধু সুজন সেখানে খেতে গিয়েছি। খাওয়ার সময় তাদের খাবারে পোকা পেয়েছি। এটা নিয়ে তাদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডা হয়েছে। কিন্তু আমরা টাকা পরিশোধ করে এসেছি। আর কোনো ঘটনার সঙ্গে আমি জড়িত নই।’
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বলেন, ‘দোকান মালিক যদি আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন তাহলে আমরা তদন্ত করে দোষী প্রমাণিত হলে অবশ্যই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেব।’
সিটি করপোরেশনের রাস্তার ওপর খাবারের দোকান থাকবে কেন- এমন প্রশ্ন তুলে সে বিষয়েও সাংবাদিকদের ভূমিকা রাখার অনুরোধ করেন ঢাবি ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন বলেন, ‘এই অভিযোগ আসার পর আমি ঘটনার সত্যতার ব্যাপারে জানতে কয়েকজনকে সেখানে পাঠিয়েছি। তারা আমাকে জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ওই দোকানের কর্মচারীদের একটা ঝামেলা হয়েছে।
‘তবে এই ঘটনায় আরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে চাঁদা দাবির যে অভিযোগ উঠেছে সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি শতভাগ নিশ্চিত যে আরিফ এ কাজ করেননি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. মাকসুদুর রহমান বলেন, ‘আমাদের কাছে এখনও লিখিতভাবে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। অভিযোগ এলে আমরা তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেব।’