মা হারানো সন্তানের আর্তনাদ, পোষাক দেখে মায়ের মরদেহ শনাক্ত ও পরবর্তীতে জীবিত মা উদ্ধার। খুলনার রহিমা বেগমের অপহরণের নাটকের পর সন্তান মরিয়ম মান্নানের এসব কর্মকাণ্ডে ঘটনাটি দেশব্যাপী আলোচনায় এসেছিল।
পুলিশ ব্যুরো অফ ইভেষ্টিগেশন (পিবিআই) ঘটনাটির তদন্তে করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে। তবে মামলাটির বিচার বিলম্বিত করতে নয়া কৌশল অবলম্বন করছেন মরিয়ম মান্নানরা।
মামলা চলমান রয়েছে খুলনার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২-এর আদালত। সোমবার এর শুনানির দিন ধার্য ছিল। তবে অপহরণ মামলার বাদী মরিয়ম মান্নানের বোন আদুরী আক্তারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুনানির দিন পিছিয়ে গেছে।
ওই আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জেসমিন পারভীন জলি বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘বাদী আদালতে জানিয়েছেন তিনি শুনানির প্রস্তুতি নিতে পারেননি। এর জন্য তার আরও সময়ের দরকার।’
এর আগে একই আদালতে গত ১৬ এপ্রিল পিবিআইয়ের দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনের বিপক্ষে নারাজির আবেদন করেন বাদী আদুরী আক্তার। আদালতের বিচারক রফিকুল ইসলাম সেটি গ্রহণ করে শুনানির জন্য ৮ মে দিন নির্ধারণ করেছিলেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর আব্দুল মান্নান চলতি বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি খুলনা মহানগর মেট্রোপলিটন আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরে সেটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তরিত হয়।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের ২৭ আগস্ট রাত সাড়ে ১০টার দিকে খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশার বণিকপাড়া থেকে রহিমা বেগম নিখোঁজ হন বলে অভিযোগ করে তার পরিবার।
২৭ আগষ্ট রাত সোয়া ২টার দৌলতপুর থানায় মায়ের অপহরণের অভিযোগে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন রহিমার ছেলে মিরাজ আল সাদী। পরে মাকে পাওয়া যাচ্ছে না জানিয়ে ২৮ আগস্টে দৌলতপুর থানায় বাদী হয়ে মামলা করেন রহিমার মেয়ে আদুরী আক্তার।
ওই মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে, তাদের প্রতিবেশী মঈন উদ্দিন, গোলাম কিবরিয়া, রফিুকল ইসলাম পলাশ, মোহাম্মাদ জুয়েল ও হেলাল শরীফের নাম জড়িয়ে দেওয়া হয়। ওই সময়ে তারা প্রত্যকে পুলিশে কাছে গ্রেপ্তার হয়ে বেশ কিছুদিন কারাভোগও করেছেন।
তবে পিবিআইয়ের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতিবেশীদের সাথে মরিয়ম মান্নানদের জমি সংক্রান্ত ঝামেলা ছিল। এই নিয়ে রহিমা বেগম আদালতে মামলা করেছিল। ওই মামলায় প্রতিবেশীরাই জিতে যাচ্ছিলেন। এছাড়া জমির রহিমার জমির অংশ তার মেয়েরা লিখে নিয়েছিল। তাই প্রতিবেশিদের ফাঁসাতেই তারা এই চক্রান্ত করেছিল।
আরও উল্লেখ করা হয়েছে, রহিমা বেগম নিখোঁজ হওয়ার ২৫ দিন আগে ঢাকার বসুন্ধারা এলাকায় মেয়ে মরিয়ম মান্নানের বাসায় গিয়েছিল তিনি। সেখানে বসেই তারা সাজিয়েছিল এই নাটক। আর ২৭ আগষ্ট বিকেলে মরিয়ম মান্নান ঢাকা থেকে মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশের মাধ্যমে খুলনাতে মায়ের কাছে এক হাজার টাকা পাঠিয়েছিল। তার মা সেখান থেকে ৯৮০ টাকা ক্যাস আউট করেছিল। পরে রাতে আত্মগোপনে চলে না। বিকাশের অফিসিয়াল তথ্য তদন্তের সাথে যুক্ত করা হয়েছে।
এ ছাড়া ময়মনসিংহের ফুলপুরে অজ্ঞাত এক নারীর মরদেহ, নিখোঁজ হওয়া রহিমা বেগমের বলে দাবি করেছিলেন মেয়ে মরিয়ম মান্নান। এ ঘটনায় ২২ সেপ্টেম্বর রাতে নিজের ফেবসুকে পোষ্ট দিয়ে দাবি করেন মায়ের লাশ পেয়েছেন। পরে ২৩ সেপ্টেম্বর ফুলপুর থানায় গিয়ে লিখিত দেন ওই মরদেহ তার মায়ের। তবে বিষয়টি নিশ্চিত হতে মরিয়মের ডিএনএ টেস্ট করেছিল পুলিশ।
এ প্রসঙ্গে পিবিআইয়ের প্রতিবেদন বলছে, ফুলপুরে গিয়ে মরিয়ম মান্নান সম্পূর্ণ নাটক করেছিল। যা তাদের চক্রান্তের একটি অংশ ছিল। অজ্ঞাত লাশকে মা হিসেবে দাবি করার ঘটনায় তারা থানায় যা লিখিত দিয়েছিল, তাও তদন্তের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে।
এই মামলাটিতে মরিয়ম মান্নান ও তার মা রহিমা বেগমের বিরুদ্ধে দুইজন ইতোমধ্যে আদালতে স্বাক্ষ্য দিয়েছেন। তারা হলেন, রহিমা বেগমের ছেলে মিরাজ ও দিত্বীয় স্বামী বেলাল হাওলাদার।
খুলনা পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘ছেলে মিরাজ মায়ের বিচার চেয়ে আদালতে ২২ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি আদালতে বলেছেন, রহিমা বেগম বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে থেকে মিথ্যা কথা বলেছিলেন। এটা তার ইগোতে লেগেছে। এ জন্য তিনি স্বেচ্ছায় মায়ের বিচার চেয়ে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।’