কুমিল্লার দাউদকান্দিতে যুবলীগ নেতা জামাল হোসেনকে হত্যার আগে কয়েক দফা বৈঠক করে ঘাতকরা। টানা দুই ঘণ্টার বৈঠকে নেয়া সিদ্ধান্তের পর মাত্র দেড় মিনিটেই শেষ হয় কিলিং মিশন।
এর আগে গৌরীপুর ও তিতাসে রাজনৈতিক ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে যত হত্যাকাণ্ড হয়েছে, তার মধ্যে যুবলীগ নেতা জামালকে ‘বোরকা পরে’ গুলি করে হত্যার ঘটনাটি সিনেমার চিত্রায়নকেও হার মানিয়েছে।
খুব সূক্ষ্ম পরিকল্পনা করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে বলে মনে করছেন আইনশৃংখলা বাহিনীর কর্মকর্তারা।
এ ঘটনার পর থেকে তিতাসের রাজনৈতিক নেতাদের মনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। পরবর্তী টার্গেট কে, এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তাদের মাথায়।
এদিকে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক টিম কাজ করছে বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, সিসিটিভি ফুটেজ দেখে দুর্বৃত্তদের চিহ্নিত করা হয়েছে। বোরকা পরে হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করলেও তাদের পরিচয় পাওয়া গেছে। যে কোনো সময় তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হবে।
মামলার নথি ঘেটে পাওয়া গেছে চাঞ্চল্যকর বেশ কিছু তথ্য।
হত্যাকাণ্ডের আগে পরে কী হয়েছিল
হত্যাকাণ্ডের দিন ঘাতকরা দীর্ঘক্ষণ জামালের জন্য অপেক্ষা করেন। তবে একজন দফায় দফায় খোঁজ খবর রেখেছিলো- জামাল কখন কোথায় আছে্ন, কি করছেন। পরে খবর পেয়ে তিন দুর্বৃত্ত বোরকা পরে এসে জামালকে লক্ষ্য করে গুলি চালান। দুই দফা গুলি করে ঘটনাস্থলেই জামালের মৃত্যু নিশ্চিত করে তারা দৌড়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। যাওয়ার আগে এক যুবকের পিস্তল হাত থেকে পড়ে যায়।
মাত্র এক থেকে দেড় মিনিটেই কিলিং মিশন শেষ করেন তারা।
ঘটনার আকস্মিকতায় প্রত্যক্ষদর্শীরা বুঝতে পারছিলেন না কি হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর স্থানীয়রা গুলিবিদ্ধ জামালকে হাসপাতালে নিয়ে যান।
বাজারের এক প্রান্তে গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটলেও অন্য প্রান্তের মানুষ জানতে পারেন প্রায় আধঘন্টা পর।
কী বলছে জামালের পরিবার
জামাল স্ত্রী ও স্বজনরা জানান, হত্যার আগে একাধিকবার জামাল হোসেন ও তার পরিবারকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছিল। জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে জামালের স্ত্রী থানায় জিডিও করেছিলেন।
পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা নিহত জামাল হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে তিতাসের সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও হত্যা, অস্ত্রসহ ৯টি মামলার আসামি সন্ত্রাসী শাহীনুল ইসলাম ওরফে সোহেল শিকদারকে দায়ী করেছেন।
মঙ্গলবার রাতে জামালের স্ত্রী পপি আক্তার মামলায় এসব কথা উল্লেখ করেন।
মামলার এজাহারে যা আছে
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, জামালকে হত্যার আগে সোহেল শিকদারের নেতৃত্বে তার ওপর একাধিকার হামলা ও প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়।
এজাহারভুক্ত আসামিরা হচ্ছেন ৩২ বছর বয়সী সুজন, ২৮ বছর বয়সী আরিফ, ৩৮ বছর বয়সী ইসমাঈল, ৪৮ বছর বয়সী সোহেল শিকদার, ৪৫ বছর বয়সী বাদল, ৩৫ বছরের শাকিল, ৩৭ বছরের শাহ আলম, ৩৯ বছরবয়সী অলি হাসান, ৪২ বছর বয়সী কালা মনির। এছাড়াও অজ্ঞাত আছেন আরও ৮ জন।
এজাহারে বলা হয়েছে, ‘হত্যাকাণ্ডের কিছুক্ষণ আগে জামাল যখন বাসার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তখন মামলার ৩ নম্বর আসামি ইসমাইল সেখানে অবস্থান করে তাকে ঠাণ্ডা পানি খাওয়ানোর কথা বলে সময়ক্ষেপণ করেন। এর কিছুক্ষণ পরই বোরকা পরা ৩ সন্ত্রাসী গুলি চালায়।
‘মৃত্যুর আগে জামাল হোসেন হত্যাকাণ্ডে জড়িত অপর আসামি সুজন ও আরিফের নাম বলে যান।’
আসামিরা সবাই সোহেল শিকদার বাহিনীর সদস্য বলে জানা গেছে।
কুমিল্লা উত্তরের ডন হতে চান সোহেল শিকদারকুমিল্লা জেলায় রাজনৈতিক মতবিরোধে যতগুলো হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে দুর্ধর্ষ হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটনা ঘটেছে তিতাস উপজেলায়। এখানে খুনের ঘটনা এখন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
কেউ কেউ বলেন, রাজনৈতিক খুনাখুনি হলো পরম্পরা।
তিতাস উপজেলা ঘুরে ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, তিতাস, দাউদকান্দিসহ আশপাশের এলাকায় নিজের আধিপত্য বিস্তার করে ডন হতে চান নিহত যুবলীগ নেতা জামাল হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড সোহেল শিকদার।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় বাসিন্দা, রাজনৈতিক নেতা ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দসহ অন্তত ৫০ জন জানান, দীর্ঘদিন ধরে সোহেল শিকদার বাহিনীর সঙ্গে তিতাসের রাজনৈতিক নেতাদের বিরোধ চলছিল।
স্থানীয়রা আরও জানান, শিকদার বাহিনীর এসব কর্মকাণ্ডে কোনো বাধা এলে সু-পরিকল্পিতভাবে তা দমন করা হয়। হত্যাকাণ্ডের আগে কেউ কোনোকিছু টের পায় না।
গৌরীপুর বাজারসহ তিতাস উপজেলা সদরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর তিতাস উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক ও জিয়ারকান্দি ইউপি চেয়ারম্যান মনির হোসাইন সরকার ও তার শ্যালক মহিউদ্দিনকে গৌরিপুর বাজারে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনার ৫ মিনিট আগেও কেউ টেয় পায়নি এমন কিছু হতে যাচ্ছে।
সে সময় ধারালো অস্ত্র ও গুলির আঘাতে মনির খুন হওয়ার পর তার গ্রুপের নেতৃত্ব ও মামলার তদারকি করতেন নিহত জামাল।
মনির হত্যা মামলায় পরে ডিবি পুলিশের হাতে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হন সোহেল শিকদার। পরে জামিনে বেরিয়ে এসে জামাল এবং মনিরের স্ত্রীকে মামলা তুলে নিতে হুমকি দিতে থাকেন। এমনকি মনিরের ঢাকার বাসায় গিয়ে তার স্ত্রী ও জামালকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিও দেয়া হয়। পরে মনিরের স্ত্রী ঢাকার কদমতলী থানায় এ বিষয়ে সোহেল শিকদারের নামে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
এদিকে ২০২২ সালের ২ নভেম্বর মনির হত্যা মামলায় স্বাক্ষীদের নিয়ে আদালতে আসেন জামাল হোসেন। ওই সময় আদালতের অভ্যন্তরে জামালসহ মামলার স্বাক্ষীদের ওপর হামলা করেন সোহেল শিকদারসহ অন্যরা।
মনির হত্যা মামলা মীমাংসা না করার জেরেই জামালকে সোহেল শিকদারসহ অন্যরা হত্যা করেছে বলে মামলার এজাহারে দাবি করা হয়েছে।
দাউদকান্দি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ আলমগীর ভূঞাঁ বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের স্ত্রী মামলা করেছেন। তবে এ ঘটনায় এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।’
কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার আব্দুল মান্নান বলেন, ‘পরিকল্পনা করেই জামালকে হত্যা করা হয়েছে। যাকে বলা হয় টার্গেট কিলিং। ইতোপূর্বে তিতাস, জিয়ারকান্দি, গৌরীপুর এলাকায় আধিপত্য নিয়ে অনেকগুলো হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আমরা অতীতের সব ঘটনাগুলো আমলে নিয়ে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি। তবে এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে কোনো রাজনৈতিক কারণ নেই বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা রেহাই পাবে না। তাদের গ্রেপ্তার করতে অভিযান চলছে।’
এর আগে, গত রোববার রাত পৌনে ৮টার দিকে দাউদকান্দির গৌরীপুর বাজারে বোরকা পরা ৩ দুর্বৃত্ত যুবলীগ নেতা জামাল হোসেনকে গুলি চালিয়ে হত্যা করেন। তাদের গুলি করে পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়ে।