কলেজছাত্রীকে শ্লীলতাহানি মামলায় কারাগারে থাকলেও সেই সময়ের বেতন-ভাতা গ্রহণ করেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন সেন্টারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফারুকুজ্জামান দাড়িয়া। দীর্ঘ এক যুগ ঘটনাটি আড়ালে থাকলেও সম্প্রতি তা আলোচনায় এসেছে।
অভিযোগ রয়েছে, তৎকালীন উপাচার্যের (ভিসি) সঙ্গে মো. ফারুকুজ্জামান দাড়িয়া ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় তিনি বরখাস্ত হননি। যদিও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি বিধিমালায় উল্লেখ রয়েছে, কোনো কর্মকর্তা কারাগারে থাকলে সেই সময়ের জন্য তাকে বরখাস্ত করতে হবে।
আদালতের নথিপত্র, মামলার এজাহার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে জানা গেছে, ২০১২ সালের ১ অক্টোবর মো. ফারুকুজ্জামান দাড়িয়ার বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা হয়। মামলায় অভিযোগ ছিল, এক কলেজ ছাত্রীকে তিনি প্রায়ই কুপ্রস্তাব দিতেন। ওই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টার দিকে তিনি নিজের বাড়ির ছাদে গিয়ে ওই কলেজ ছাত্রীর শ্লীলতাহানি করেন।
পরবর্তীতে ছাত্রীর মা ১ অক্টোবর থানায় তার মামলা দায়ের করেন। পরদিন ওই মামলায় তিনি গ্রেপ্তার হয়ে ২১ দিন কারাগারে ছিলেন। পরে জামিন পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অসুস্থ থাকার কথা বলে সনদ দাখিল করে বেতন-ভাতা উত্তোলন করেন।
মামলার বাদী বলেন, ‘বেতন-ভাতা গ্রহণের ঘটনাটি জানতে পেরে ২০১৪ সালে আমি সাবেক উপাচার্য ফায়েক উজ্জামানের কাছে তথ্য-প্রমাণসহ অভিযোগ দিয়েছিলাম। তিনি সেটা আমলে নেননি। বরং অভিযুক্ত মো. ফারুকুজ্জামান দাড়িয়াকে সহায়তা করেছিলেন। কারণ তাদের দুজনের বাড়িই এক জেলায়।
‘এখন ড. ফায়েক উজ্জামান উপাচার্য পদে নেই। তাই বিচার পাওয়ার ভরসায় ১৩ এপ্রিল দুর্নীতি দমন কমিশন, ইউজিসি ও বর্তমান উপাচার্যের কাছে অভিযোগ দিয়েছি।’
অভিযোগপত্রে অভিযুক্ত কর্মকর্তার তথ্য গোপন করা এবং বিষয়টি জেনেও তার বিরুদ্ধে বিধি অনুয়ায়ী ব্যবস্থা না নেয়ায় সাবেক উপাচার্য ড. ফায়েক উজ্জামানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণেরও দাবি জানানো হয়েছে।
সম্প্রতি ওই অভিযোগের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বিস্তারিত জানতে চেয়েছে ইউজিসি। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর খান গোলাম কুদ্দুস বলেন, ‘এই সপ্তাহে ইউজিসি এ বিষয়ে আমাদের একটি চিঠি দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যানেল আইনজীবীর মতামত চেয়েছি। তাদের পরামর্শ পাওয়ার পর ইউজিসিতে বিস্তারিত তথ্য পাঠানো হবে।’
রেজিস্ট্রার বলেন, ‘ছাত্রীর মায়ের অভিযোগ ও ইউজিসির চিঠি পাওয়ার পর আমরা প্রকৌশলী মো. ফারুকুজ্জামান দাড়িয়ার নথিপত্র যাছাই করেছি। তাতে অভিযোগের সঙ্গে মিল পেয়েছি। তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
ছাত্রীর মা জানান, ফারুকুজ্জামান দাড়িয়ার নামে এমন আরও কয়েকটি মামলা রয়েছে। তার মধ্যে ২০১২ সালে খালিশপুর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা, কোটালীপাড়া থানায় হত্যাচেষ্টা মামলা, ২০১৩ সালে খালিশপুর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা, ২০১৪ সালে খুলনার সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে দুর্নীতি মামলা, ২০১৫ সালে খুলনা মহানগরের সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে দুর্নীতি মামলা, ২০১৬ সালে খুলনা থানায় চাঁদাবাজি মামলা, খালিশপুর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা, ২০১৭ সালে হরিণটানা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা উল্লেখযোগ্য।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রকৌশলী মো. ফারুকুজ্জামান দাড়িয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘২০১২ সালে আমি খালিশপুরে গণপূর্ত থেকে বরাদ্দ নেয়া একটি বাড়ির নিচতলায় থাকতাম। যে ছাত্রীর মা অভিযোগ দিয়েছেন তারা ওই বাড়ির দোতলায় গণপূর্ত থেকে বরাদ্দ নিয়ে থাকতেন। সরকারি বাড়ির পুরোটাই তারা দখলে দিতে চাচ্ছিল। সেজন্য আমাকে হয়রানি করতে হঠাৎ করে উদ্দেশ্যমূলক একটি মিথ্যা মামলা দেয়। ওই মামলাটি এখন হাইকোর্টের আন্ডারে আছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি জেলে ছিলাম এটা সত্য। তবে ওই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঈদের ছুটির বন্ধ চলছিল। বাকি কয়েকদিন কার্যদিবস চলেছিল। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ছুটি মঞ্জুর করেছে বলেই বেতন-ভাতা পেয়েছিলাম।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘আপন বোনের সঙ্গে আমার জমিজমা নিয়ে ঝামেলা রয়েছে। ওই বোনের বর আমার প্রতিপক্ষকে দিয়ে আমাকে হয়রানির চেষ্টা করছে। ওই মহিলা সম্প্রতি যেসব অভিযোগ দিচ্ছেন, তা আমার বোনের বরের ইন্ধনে দেয়া হচ্ছে।’
অধ্যাপক ফায়েক উজ্জামান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক। বর্তমানে ওই বিভাগের চেয়ারম্যান পদে কর্মরত রয়েছেন। তিনি ২০১০ সালের ২৮ নভেম্বর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান।
তখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক মো. শাইফুদ্দিন শাহ। ২০১২ সালের অক্টোবরে তার মেয়াদ শেষ হলে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান ফায়েক উজ্জামান। ২০১৩ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি পূর্ণ উপাচার্যের দায়িত্ব পান। সেখান থেকে পরপর দুই মেয়াদে উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করে ২০২১ সালের ২৯ জানুয়ারি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যান তিনি।
উপাচার্য পদে দ্বিতীয় মেয়াদে ড. ফায়েক উজ্জামানের বিরুদ্ধে অহরহ দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নিয়োগের অভিযোগ রয়েছে। স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের ঘটনায় তার বিরুদ্ধে একটি তদন্ত চলমান।
রেজিস্ট্রারের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ডিসিপ্লিনে (বিভাগ) ওয়ালিউল হাসানাত নামে একজন অধ্যাপকের নিয়োগে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়ার অভিযোগ রয়েছে সাবেক উপাচার্যের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় ২০২২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে ইউজিসির চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে ওই শিক্ষককের নিয়মবর্হিভূত নিয়োগের ব্যাপারটি জানিয়ে তা তদন্ত করার অনুরোধ জানানো হয়। সে পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ৫ জুন ইউজিসি তদন্ত কমিটি গঠন করে। বর্তমানে তদন্তটি শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ফায়েক উজ্জামানকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে মোবাইল ফোনে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।