তীব্র গরম, কাঠফাটা রোদে বিপর্যস্ত মানুষের জীবন। তবে এই কাঠফাটা রোদ সুনামগঞ্জের হাওরের কৃষকের মুখে হাসি এনে দিয়েছে। বৃষ্টি আর ঢলের পানিতে ফসল হারানোর শঙ্কা অনেকটাই দূর হওয়ায় এই রোদকে তারা স্বাগত জানাচ্ছেন।
ফসলহানির শঙ্কায় হাওরের নিম্নাঞ্চলের ক্ষেতের ধান আগে কাটা হচ্ছে। এ নিয়ে কৃষকদের মধ্যে ব্যস্ততার শেষ নেই। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা শ্রমিকদের নিয়ে তারা দিনমান পরিশ্রম করে চলেছেন। যেভাবেই হোক, হাওরাঞ্চলে ধানের বাম্পার ফলনের সুফলটা ঘরে তোলা চাই।
অপেক্ষাকৃত উঁচু জমির ধান ক্ষেতগুলোতে এখন সেভাবে কাস্তের কোপ পড়েনি। সবাই ব্যস্ত নিচু জমির ক্ষেতে। কোনো কোনো ক্ষেতের ধান পুরোপুরি পাকেনি। তারপরও কৃষকরা অপেক্ষা করছেন না। তবে শীষের অধিকাংশ ধানই পুষ্ট হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে নিম্নাঞ্চলের ক্ষেত থেকে অধিকাংশ ধান কৃষকরা ঘরে তুলে এনেছেন।
ধান কাটা শেষে হাওরের পাশেই ধান ও খড় শুকানোতে ব্যস্ত কৃষক-কৃষাণী। ছবি: নিউজবাংলা
সুনামগঞ্জের কালিয়াকোটার হাওরের কৃষক ফয়েজ মিয়া বলেন, ‘এবারের বৈশাখে কড়া রোদে ধান তাড়াতাড়ি পেকেছে। ঠিক তেমনি ধান ও খড় শুকাতে পেরেছে কৃষকরা। অন্যান্য বছর বৃষ্টির পানির জন্য হারভেস্টার মেশিন দিয়ে ধান কাটা বা ধান পরিবহনে কষ্ট হতো। এ বছর কড়া রোদ থাকায় এবং এখন পর্যন্ত বৃষ্টি ও ঢলের বাগড়া না থাকায় সেই সমস্যাটা হচ্ছে না।’
জেলার বৃহৎ বোরো ফসলি হাওরের উপজেলা তাহিরপুরেও এবার ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে।
ভাটি তাহিরপুর গ্রামের কৃষক ইউনুছ আলী বলেন, ‘এবারের ফসলের সঙ্গে আগের বছরগুলোর ফলনের কোনো তুলনা হয় না। বিগত ১৫ বছরের মধ্যে এবার ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে।’
উপজেলার ছোট-বড় ২৩টি হাওরে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। হাওরাঞ্চলের কৃষকদের ধানের গোলা পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে সোনালি ধানে। পর্যাপ্ত সংখ্যক কম্বাইন্ড হারভেস্টার থাকায় বোরো ধান কাটা ও মাড়াইয়ের সুবিধা পেয়েছেন তারা। ফলন ভালো হওয়ায় এবং প্রকৃতির কোনো ধরনের বিরূপতা ছাড়াই ধান ঘরে তুলতে পারায় কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে।
তাহিরপুরের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বছর দুই দফা বন্যার পানির সঙ্গে ভেসে আসা পলিমাটির কারণে এবার ফসল বেশি হয়েছে। এছাড়া বেশ কয়েক জাতের উচ্চ ফলনশীল ধান হাওরকে ফসলে ভরিয়ে দিয়েছে।
হাওরাঞ্চলে ধানের বাম্পার ফলন হাসি ফুটিয়েছে পুরো কৃষক পরিবারে। ধান কেটে শিশুদের নিয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফিরছেন এক কৃষক। ছবি: নিউজবাংলা
সরেজমিনে দিরাইয়ের কালিয়াকোটা, বরামসহ বিভিন্ন হাওর ঘুরে দেখা যায়, ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। কাঠফাটা রোদ হাওরের ধান দ্রুত পাকতে সাহায্য করেছে। বৃষ্টি না হওয়ায় ক্ষেতের ধানেও শুকনো। কম্বাইন্ড হারভেস্টার দিয়ে ধান কেটে সহজেই ট্রাক্টর, ট্রলি বা ইঞ্জিনচালিত যান দিয়ে কৃষকরা বাড়ি নিয়ে এসেছেন। সেগুলো শুকিয়ে গোলায় তুলেও ফেলেছেন।
কৃষক রানু পুরকায়স্থ বলেন, ‘খড়া থাকার সুযোগে আমাদের কালিয়াকোটা হাওরের জটিচর, কাইমা, মধুপুর, দলুয়া, গচিয়া, অনন্তপুর, মির্জাপুর অংশেই ১১-১২টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার দিয়ে কৃষকরা দিন ও রাতে ধান কেটে আনছেন। ফসল সংগ্রহও প্রায় শেষ পর্যায়ে।’
কৃষক মুক্তার মিয়া জানান, গত বছরের অকাল বন্যায় বেশকিছু হাওর ডুবে গিয়ে শত শত কৃষক নিঃস্ব হয়ে পড়েছিল। তবে এ বছর এখন পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ধান কাটা ও শুকাতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।তবে সুনামগঞ্জ সদরের শিয়ালমারা হাওরের কৃষক মইনুদ্দীন বলেন, ‘এবার ব্রি২৮ ধানের বেশ কিছু জমিতে ব্লাস্ট রোগ দেখা দেয়ায় ফলন কিছুটা কম হয়েছে। আগামীতে ব্রি২৮-এর পরিবর্তে অন্য কোনো ধান চাষ করতে হবে।’
সুনামগঞ্জ সদরের গোয়াচোরা হাওরের কৃষাণী ফুলেছা বলেন, ‘সরকারি গুদামে ন্যায্যমূল্যে ধান দিতে পারলেই আমরা খুশি হবো।’
তাহিরপুর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার শনি, মাটিয়ান, মহালিয়া, বর্ধিতগুরমা, সমসা, নাইন্দা, খাউজ্যাউরি, নাওটানা, গণিয়াকুরিসহ প্রায় ২৩টি হাওরে এ বছর ১৭ হাজার ৪২০ হেক্টর জমিতে বএরা ধান আবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৩ হাজার ৩৯০ হেক্টর হাওরের জমিতে চাষাবাদ হয়েছে এবং ৪ হাজার ৩০ হেক্টর বিভিন্ন কিত্তায় (গ্রামের পাশে) জমিতে চাষাবাদ হয়েছে। ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬৫ হাজার টন।
হাওর থেকে ধান কেটে আনার পর চলছে মাড়াইয়ের প্রস্তুতি। ছবি: নিউজবাংলা
তাহিরপুর উপজেলা কৃষি অফিসার মো. হাসান-উদ-দৌলা বলেন, ‘তাহিরপুর উপজেলায় এ বছর ১৭ হাজার ৪২০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষাবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৩ হাজার ৩৯০ হেক্টর হাওরের জমিতে চাষাবাদ হয়েছে এবং ৪ হাজার ৩০ হেক্টর বিভিন্ন কিত্তার (গ্রামের পাশে) জমিতে চাষাবাদ হয়েছে। ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬৫ হাজার টন।’
দিরাই উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মনোরঞ্জন অধিকারী জানান, এ বছর উপজেলার ছোট-বড় ১০ টি হাওরে ৩০ হাজার হেক্টর বোরো জমিতে ধানের আবাদ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৮৯ ভাগ ধান কাটা হয়ে গেছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯১ হাজার ১৯৭ টন।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, ‘হাওরের ৯০ ভাগ ধান কাটা শেষ হয়েছে। এ বছর ১ হাজার কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিনের পাশাপাশি ২ লাখ ৬৫ হাজার শ্রমিক হাওরে ধান কাটছে।’