মনোনয়নপত্র দাখিলের মধ্য দিয়ে জমে উঠেছে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন। আর মূল আলোচনায় আওয়ামী লীগ মনোনীত অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক বরখাস্ত মেয়র জাহাঙ্গীর আলম।
আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী হিসেবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েই জাহাঙ্গীর আলম গুম হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, কালকের পর হয়তো আমার পায়ে শেকল পরাতে পারে। আমাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে।
অপরদিকে নৌকার প্রার্থী আজমত উল্লা খান বলেছেন, ‘আমার শক্তি জনগণ। আমি কাউকে প্রতিপক্ষ মনে করি না। নৌকার পক্ষে জনতা আছে, তাই আমি কাউকে নৌকার প্রতিপক্ষ মনে করি না।’
বৃহস্পতিবার মনোনয়নপত্র জমার শেষ দিনে আজমত উল্লাহ খান ও জাহাঙ্গীর আলমসহ মেয়র পদে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন আটজন প্রার্থী। এর আগে বুধবার মেয়র পদে আরও চারজন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দেন।
দুপুর ১২টার দিকে নেতাকর্মীদের নিয়ে শহরের বঙ্গতাজ অডিটরিয়ামে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে আসেন নৌকার প্রার্থী আজমত উল্লা খান। পরে তিনি অল্প কয়েকজন নেতাকর্মী নিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলামের কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেন। তবে আচরণবিধি ভঙ্গ করে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ের বাইরে গাজীপুর জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী উপস্থিত ছিলেন।
মনোনয়ন জমা দেয়ার সময় আজমত উল্লা খানের সঙ্গে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণ, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউল্লাহ মণ্ডল, মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মতিউর রহমান মতি, মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক কামরুল আহসান সরকার রাসেল ও মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।
আজমত উল্লা খান যা বললেন
মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার পর এক প্রতিক্রিয়ায় আজমত উল্লাহ খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা আমাদের অস্তিত্বের নির্বাচন, দুর্নীতমুক্ত সিটি করপোরেশন গঠনের নির্বাচন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ার নির্বাচন। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে গাজীপুর সিটি করপোরেশনকে স্মার্ট নগরী উপহার দিতে চাই।’
আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, ‘গাজীপুর নগরবাসী চায় একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক সিটি করপোরেশন গঠিত হোক। আমি নির্বাচিত হলে অনিয়ম ও দুর্নীতিমুক্ত জনকল্যাণমুখী একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সিটি করপোরেশনকে গড়ে তুলব।’
আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের সব নেতা-কর্মী ঐক্যবদ্ধ রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে আমাদের বিজয় সুনিশ্চিত ইনশাআল্লাহ।’
জাহাঙ্গীর আলম যা বললেন
সাময়িক বরখাস্ত মেয়র মো. জাহাঙ্গীর আলমের পক্ষে এলাকার সাধারণ মানুষ এবং জাহাঙ্গীর আলম তার মায়ের পক্ষে বিকেল ৩টার দিকে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেন। এসময় জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সাবেক সদস্য আসকর আলী, সাবেক সহ-দফতর সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম এবং সাবেক গাছা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল কাদির উপস্থিত ছিলেন।
মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার পর উপস্থিত সাংবাদিকদের জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ, প্রধানমন্ত্রী ও নৌকা আমার কাছে একটা শ্রদ্ধার জায়গা। আমি ব্যক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি। যে এই শহরকে ধ্বংস করবে তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি।
‘আমার মা বলেছেন যে শহর রক্ষা করতে যা প্রয়োজন তা করো। সে হিসেবে মায়ের দোয়া ও সহযোগিতা নিয়ে এখানে দাঁড়িয়েছি। আমি ভোটের মাধ্যমে প্রমাণ করে দেব কে খারাপ আর কে ভালো। কে অন্যায়কারী আর কে সৎ। সত্যকে প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠিত করতে মা ও ছেলে মিলে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছি।’
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমি আমার শহর রক্ষা করতে চাই। শহরের মানুষ আমাকে ভোট দিয়ে ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত করেছিল। আমি শহরের মানুষের কাছে একটা পরীক্ষা দিতে চাই। নির্বাচন থেকে স্বেচ্ছায় সরে যাওয়ার কোনো পথ নেই। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকার জন্য। আমি এই শহরের মানুষকে নিয়ে লড়তে চাই, যদি না আমাকে সরিয়ে দেওয়া না হয়।’
তিনি বলেন, ‘কালকের পর হয়তো আমার পায়ে শেকল পরাতে পারে। আমাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। আমাকে গুম করতে পারে। আমি দেশবাসী ও নগরবাসীকে বলে যাই- যদি আমার মৃত্যু হয়, আপনারা বিশ্বাস করবেন যে এই শহর রক্ষা করতে গিয়ে যা যা ভাল কাজ আছে আমি সব করেছি।’
নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও সুন্দর ভোট প্রত্যাশা করে জাহাঙ্গীর আরও বলেন, ‘আজ আমার কাছ থেকে সব ছায়া সরে গেছে। কিন্তু আল্লাহর ছায়া, মায়ের ছায়া, নগরবাসীর ছায়া এবং দেশের আপামর জনগণের ছায়া রয়েছে। এই নগরীতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাই। আমি কোনো অন্যায় করে থাকলে এই শহরের মানুষ ভোটের মাধ্যমে তার বিচার করবে। আর যদি ভালো কিছু করে থাকি তাহলে অবশ্যই সত্যের জয় হবে।’
মেয়র পদে প্রার্থী হয়েছেন রনি
একইদিন সকালে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হাসান উদ্দিন সরকারের ভাতিজা সরকার শাহনুর ইসলাম রনি। রনি বিএনপির সাবেক কেন্দ্রীয় যুব বিষয়ক সম্পাদক নুরুল ইসলাম সরকারের ছেলে। নুরুল ইসলাম সরকার গাজীপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে বর্তমানে কারাগারে বন্দি।
মনোনয়নপত্র জমাদানের পর রনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি বিএনপি পরিবারের সন্তান। আমার চাচা, বাবা সবাই বিএনপির রাজনীতি করেন। আমি ইতোমধ্যে অনেকউঠোন বৈঠক করেছি। তৃণমূল কর্মীদের সমর্থন পেয়েছি। সে কারণে আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করব। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জয়ের ব্যাপারে আমি আশাবাদী।’
বিএনপির পক্ষ থেকে সমর্থন বা বাধা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিএনপি হয়তো নির্বাচনে আসছে না। কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ের বিএনপির সমর্থন আমার প্রতি রয়েছে। আমি বুঝেশুনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি বিশ্বাস করি, আমার সঙ্গে সবাই থাকবেন। শুধু বিএনপি নয়, রাজনৈতিক দল-মত নির্বিশেষে সবাই আমাকে সমর্থন করবেন। আমার মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে নৌকার প্রার্থী আজমত উল্লা খানের সঙ্গে।’
আচরণ বিধি লঙ্ঘন: দুই মেয়র ও এক কাউন্সিলর প্রার্থীকে শো-কজ
আচরণ বিধি লঙ্ঘনের দায়ে দুই মেয়র প্রার্থী এবং একজন কাউন্সিলর প্রার্থীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা। নোটিশপ্রাপ্তরা হলেন- স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী (আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী) আব্দুল্লাহ আল মামুন মণ্ডল, জাতীয় পার্টি মনোঈত প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন ও নগরীর ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদপ্রার্থী সনজিৎ মল্লিক।
শো-কজ নোটিশে ২৮ এপ্রিলের (শুক্রবার) মধ্যে প্রচার সংক্রান্ত সব পোস্টার ও বিলবোর্ড নিজ খরচে অপসারণের নির্দেশ দেয়া হয়। এছাড়াও ওই বিধিমালার অধীনে কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না সে বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। অন্যথায় আইন ও বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
রিটার্নিং কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম জানান, নির্বাচন সুশৃংখল করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। প্রার্থীদের আচরণবিধি মেনে চলতে বিভিন্ন এলাকায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, গাজীপুর সিটি নির্বাচনে মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই ৩০ এপ্রিল ও প্রার্থিতা প্রত্যাহারের দিন ৮ মে। প্রতীক বরাদ্দ হবে ৯ মে এবং ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে ২৫ মে।
সিটি করপোরেশনের ৫৭টি ওয়ার্ডে মোট ভোটার সংখ্যা ১১ লাখ ৮৪ হাজার।