দেশের বৃহৎ সিটি করপোরেশন গাজীপুরে তৃতীয়বারের মতো সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ২৫ মে। ইতোমধ্যে এই নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও টঙ্গী পৌরসভার সাবেক মেয়র অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে। তবে মনোনয়ন পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে এবারও ক্ষমতাসীন দলটির ভেতরে কোন্দল স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এটা ভোটের মাঠে ক্ষমতাসীন দলটিকে বেশ বেকায়দায় ফেলতে পারে বলে ধারণা করছেন স্থানীয়রা।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন (গাসিক) নির্বাচনে আজমত উল্লা খান ছাড়াও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন সাবেক বরখাস্তকৃত মেয়র জাহাঙ্গীর আলমসহ ১৭জন। ১৫ মে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সভা শেষে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মেয়র পদে আজমত উল্লাকে মনোনয়নের ঘোষণা দিলে ভোটের মাঠ থেকে সরে দাঁড়ান অধিকাংশ প্রার্থী।
তবে ওইদিনই এক প্রতিক্রিয়ায় সাবেক বরখাস্ত মেয়র জাহাঙ্গীর আলম গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ‘আমার ভোটাররা যা চাইবে আমি তাই করব। তারা আমার মৃত্যু চাইলে আমি তাতেও রাজি।’ ওই বক্তব্যেই আভাস পাওয়া গিয়েছিল যে ভোটের মাঠে থাকছেন জাহাঙ্গীর আলম। আর তার কর্মী-সমর্থকরাও নির্বাচনের প্রচার শুরু করেন।
অন্যদিকে প্রকাশ্যে প্রচার না চালালেও কেন্দ্রীয় নেতাদের বাড়ি ও অফিসে দৌড়ঝাঁপ করতে থাকেন জাহাঙ্গীর। তিনি চান যেহেতু নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী দেবে না তাই জাতীয় নির্বাচনের আগে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের জন্য তিনি প্রার্থী হতে চান। আর প্রার্থী হলে দলীয় কিংবা প্রশাসনিকভাবে যেন হয়রানি করা না হয় সেই সিগন্যাল পেতেই কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন জাহাঙ্গীর আলম।
এছাড়াও সিটি করপোরেশনরে ৩৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক উপ-কমিটির সাবেক সদস্য আব্দুল্লাহ আল মামুন মণ্ডল স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে যাচ্ছেন। বুধবার নেতাকর্মী ও সমর্থকদের নিয়ে তিনি মেয়র পদে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন।
এ সময় মামুন মণ্ডল বলেন, ‘জনগণ আমাকে ভালোবাসে। জনগণের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে আমি মনোনয়নপত্র দাখিল করেছি। ভোটের মাঠে আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে থাকব।
জাহাঙ্গীর আলম ও তার মা জায়েদা খাতুন। ফাইল ছবি
মনোনয়ন ফরম কিনলেন জাহাঙ্গীর আলম ও তার মা
এদিকে দলের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে রির্টানিং অফিসারের কাছ থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন জাহাঙ্গীর আলম। বুধবার বিকেলে তিনি বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। মনোনয়ন ফরম কিনেছেন তার মা জায়েদা খাতুনও।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই জাহাঙ্গীর আলমের ওপর তার কর্মী-সমর্থকদের ব্যাপক চাপ তৈরি হয়েছিল নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য। প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বিভিন্ন ইউনিটের কর্মী-সমর্থকরা তার বাড়িতে ভিড় করে আসছেন। তাদেরকে প্রার্থী হওয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে আশ্বস্ত করে বলেছেন, তিনি আরও একবার পরীক্ষা দিতে প্রস্তুত। প্রথম থেকেই দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার আভাস পাওয়া গেলেও মনোনয়ন ফরম সংগ্রহের মধ্য দিয়ে বুধবার বিষয়টি স্পষ্ট হলো।
কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাহাঙ্গীর আলম নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ নিতে যাচ্ছেন। তবে দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় দল থেকে কোনো চাপ এলে বিকল্প হিসেবে তার মাকে নিয়েই মাঠে নামবেন কর্মী-সমর্থকরা। সেজন্য তার মা জায়েদা খাতুনও নির্বাচনে অংশ নিতে সম্মত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার জাহাঙ্গীর ও তার মা মনোনয়ন ফরম জমা দেয়ার কথা রয়েছে।
জাহাঙ্গীর আলমের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-দপ্তর সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দল জনপ্রিয় কাউকে মনোনয়ন দেবে সেই প্রত্যাশা ছিল সবার। তবে যেহেতু তা হয়নি, তাই জনগণের চাওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন জাহাঙ্গীর আলম। আর নির্বাচনী কৌশল হিসেবে ভোটের মাঠে পাশে থাকবেন তার মা।
মনোনয়ন ফরম সংগ্রহের বিষয়ে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমি আরেকবার পরীক্ষা দিতে প্রস্তুত। নির্বাচনে সাধারণ জনগণকে যে ওয়াদা দিয়েছিলাম তাতে ৩ বছরের মধ্যে আমাকে বরখাস্ত করে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে। বাকি কাজ শেষ করতে চ্যালেঞ্জটা নিতে যাচ্ছি। এ লক্ষ্যেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন ফরম তুলেছি।’
অন্যদিকে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া আজমত উল্লাহ খান ছিলেন টঙ্গী পৌরসভার তিনবারের নির্বাচিত মেয়র। পরে টঙ্গী পৌরসভা ও গাজীপুর পৌরসভা নিয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশন গঠনেও তার অবদান ছিল উল্লেখ করার মতো।
২০১৩ সালে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন না হলেও দল থেকে আজমত উল্লা খানকে একক প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। তবে ওই নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীর কাছে ধরাশয়ী হন তিনি। পরেরবার আজমত উল্লাহ খানকে বাদ দিয়ে দল মনোনয়ন দেয় জাহাঙ্গীর আলমকে।
তবে এরপরও থেমে থাকেননি তিনি। নানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে রাজনীতির মাঠে ছিলেন সক্রিয়। হঠাৎ করে জাহাঙ্গীর আলম বেকায়দায় পড়লে ফের আলোচনায় আসেন আজমত উল্লাহ খান। অবশেষ নানা নাটকীয়তার পর গাজীপুর সিটির তৃতীয় নির্বাচনে তাকে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
জাহাঙ্গীর আলমের প্রার্থিতা নিয়ে বিচলিত নন জানিয়ে আজমত উল্লা খান বলেন, ‘কে প্রার্থী হলো সেটা আমাদের দেখার বিষয় না। আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য একটাই- জনগণের কাছে যাওয়া, নৌকার পক্ষে ভোট চাওয়া। আমরা সেই কাজটিই করছি।
‘আর যে কেউ চাইলে নির্বাচন করতে পারে। তবে আওয়ামী লীগের কেউ যদি দলের নির্দেশনা অমান্য করে তবে দল গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। এখনও সময় আছে, আগামী ৮ তারিখ মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন পর্যন্ত আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে।’
আজমত উল্লাহ খান বলেন, ‘শুনেছি জাহাঙ্গীর আলমের পাশাপাশি তার মা-ও মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। এটা হয়তো তাদের ভিন্ন কৌশল। আমরা এতে বিচলিত নই। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের প্রতি যাদের আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধ আছে, তারা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করবে না।
‘গাজীপুরের জনগণ ও দলীয় নেতাকর্মীরা আমার পাশে আছে। বিদ্রোহী প্রার্থী নৌকার বিজয়ে প্রভাব ফেলবে না। ইনশাআল্লাহ নির্বাচনে নৌকার বিজয় হবে।’
মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউল্লাহ মণ্ডল বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যাকে মনোনয়ন দিয়েছেন তিনিই আমাদের প্রার্থী। এর বাইরে অন্য কেউ প্রার্থী হলেও দলীয় নেতাকর্মীরা তাকে প্রত্যাখ্যান করবে। আমরা দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার জন্য ইতোমধ্যে নির্বাচনী কৌশল নির্ধারণ করেছি।’
এদিকে এর আগে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, ইসলামী আন্দোলন, গণফ্রন্টসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল মেয়র পদে মনোনয়ন ফরম কিনলেও বিএনপির কেউ এখন পর্যন্ত মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেননি।
নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম জানান, বুধবার পর্যন্ত মেয়র পদে ১৩, সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর পদে ৯৮ ও সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদে ৩৪০ জন মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। তফসিল অনুযায়ী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ ও জমা দেয়া যাবে।
৩০ এপ্রিল মনোনয়নপত্র বাছাই এবং ৮ মে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ। ৯ মে প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হবে। ২৫ মে দেশের বৃহৎ এই সিটি করপোরেশনে ইভিএম-এর মাধ্যমে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
নির্বাচনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা কামরুল হাসান বলেন, ‘গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ৫৭টি ওয়ার্ডে ভোট নেয়ার জন্য ৪৭৮টি কেন্দ্র থাকবে, কক্ষ থাকবে ৩ হাজার ৪৯১টি। আর অস্থায়ী ভোট কক্ষের সংখ্যা ৪৮৬টি। এছাড়া প্রিসাইডিং অফিসার ৪৭৮, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ৩ হাজার ৪৯১ ও পোলিং অফিসার থাকবেন ৬ হাজার ৯৮২ জন।