‘আমি চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে দিতাম প্রয়োজনে, কিন্তু কেন আমার ভাইকে খুন করা হলো? নির্বাচনে হারার পর থেকে বিভিন্ন সময় কাশেম জিহাদী হুমকি দিয়ে আসছিল। পরিকল্পিতভাবেই আমার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। কাশেম জিহাদী ছাড়া আমাদের কোনো শত্রু নেই। তিনিই আমার ভাই ও রাকিবকে হত্যা করেছেন।’
বুধবার কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় মঙ্গলবার রাতে গুলিতে নিহত জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমানের বড় ভাই ও বশিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান।
অভিযোগ করে তিনি আরও বলেন, ‘১৯৯৬ সালের পর থেকে বশিকপুরে যত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে সবগুলো এই কাশেম জিহাদীই ঘটিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার ভাই হত্যার বিচার চাই।’
মঙ্গলবারের ঘটনায় নিহত আরেকজন জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিব হোসেনের বাবা রফিক উল্যা বলেন, ‘নির্বাচনের পর থেকেই জিহাদী আমার ছেলেকে হুমকি দিয়ে আসছে। গেল বছর ২০ ডিসেম্বর পোদ্দার বাজার কায়েকোবাদ অডিটোরিয়ামে জিহাদী আমার ছেলেকে প্রকাশ্যে মারধর করেছে।
‘তখন মামলা দিতে চাইলে পুলিশ নেয়নি। আমার ছেলেকে জিহাদীই হত্যা করেছে। নির্বাচনে তার বিরোধিতা করায় আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। আমি কাশেম জিহাদীর বিচার চাই।’
পুলিশ জানিয়েছে, মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে সদর উপজেলার বশিকপুর ইউনিয়নের পোদ্দার বাজারে ওই হামলা হয়। নোমানকে মৃত অবস্থায় হাসাপাতালে নেয়া হয়। রাকিবের মৃত্যু হয় ঢাকা নেয়ার পর। বুধবার বিকেল ৪টা পর্যন্ত এ ঘটনায় মামলা হয়নি এবং কেউ গ্রেপ্তারও হয়নি।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বশিকপুর ইউনিয়নে দীর্ঘদিন ধরে আবুল কাশেম জিহাদী বাহিনী গড়ে সন্ত্রাসী কাজ করছেন। সদর ও চন্দ্রগঞ্জ থানায় তার নামে হত্যাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। বশিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও চন্দ্রগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবুল কাশেম জেহাদী গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেন। অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মাহফুজুর রহমান। নির্বাচনে কাশেম জেহাদীর ভরাডুবি হয়। ওই নির্বাচন নিয়েই কাশেম ও তার অনুসারীদের সঙ্গে মাহফুজ-নোমান গ্রুপের দ্বন্দ্ব চলছিল।
এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে বুধবার সকালে কাশেম জিহাদীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।
গত ৫ এপ্রিল ওমরা করার জন্য নোমান সৌদি আরব যান। ২০ এপ্রিল তিনি দেশে ফেরেন। এরপর ঢাকার বাসা থেকে তিনি ঈদের দিন বশিকপুর গ্রামে আসেন। নোমানের স্ত্রী ও দুই শিশু ছেলে সন্তান রয়েছে। নোমান বশিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মাহফুজুর রহমানের ছোট ভাই ও একই গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে। তিনি লক্ষ্মীপুর জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও প্রস্তাবিত জেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক। রাকিব বশিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোক্তা ও একই ইউনিয়নের নন্দীগ্রামের রফিক উল্যার ছেলে।
দলীয় নেতা-কর্মী ও স্থানীয়রা জানান, ঘটনার আগে যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নোমান পোদ্দারবাজারে ছিলেন। ওই সময় তার সঙ্গে থাকা অন্যদের বিদায় দিয়ে তিনি ছাত্রলীগের সাবেক নেতা রাকিবকে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে যাচ্ছিলেন। মোটরসাইকেলটি রাকিব চালাচ্ছিলেন। পথেই সন্ত্রাসীরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এ সময় তাদের ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও নোমানের মোবাইল ফোনও নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। পরে গুলির শব্দে স্থানীয়রা ঘটনাস্থলে গিয়ে নোমান ও রাকিবকে পড়ে থাকতে দেখেন। দ্রুত তাদের উদ্ধার করে জেলা সদর হাসপাতালে নেয়া হয়।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি একেএম সালাহ উদ্দিন টিপু বলেন, খুনি যেই হোক পুলিশ তা শনাক্ত করবে। দ্রুত খুনিদেরকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।
চন্দ্রগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওহাব বলেন, জেলা আওয়ামী লীগ থেকে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত না পাওয়ায় কর্মসূচি দেয়া হয়নি। কাশেম জিহাদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে অবশ্যই তদন্ত করা হবে। তদন্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
লক্ষ্মীপুর পৌরসভার মেয়র মোজাম্মেল হায়দার মাসুম ভুঁইয়া বলেন, হত্যার ঘটনার কথা শুনে সাথে সাথেই আমি সদর হাসপাতালে গিয়েছিলাম। পরবর্তীতে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ মিছিল করেছি।
নোমান ও রাকিবের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সংসদ সদস্য নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়ন। তিনি বলেন, সন্ত্রাসীরা কোনোদলের নয়। এ হত্যার সাথে যারাই জড়িত তাদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মিয়া মো. গোলাম ফারুক পিংকু বলেন, নোমান এবং রাকিব অত্যন্ত পরিশ্রমী ও দায়িত্বশীল নেতা ছিলেন। তাদের এ হত্যাকাণ্ড মেনে নেওয়র মত নয়। আমি এসপির সাথে কথা বলেছি। অতি দ্রুত আসামিদের গ্রেপ্তার করার দাবি জানাচ্ছি।
লক্ষ্মীপুর পুলিশ সুপার মো. মাহফুজ্জামান আশরাফ বলেন, যারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কাশেম জেহাদীকে দায়ী করার বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সুপার বলেন, কে বা কারা ঘটনাটি ঘটিয়েছেন, তা এখনো জানা যায়নি। অন্য কোনো পক্ষও ঘটনাটি ঘটিয়ে থাকতে পারে। যারাই ঘটনাটি ঘটিয়েছে, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
চন্দ্রগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. তহিদুল ইসলাম বলেন, ঘটনাস্থল এবং বশিকপুরে বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এঘটনায় এখন পর্যন্ত নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়নি। তদন্ত সাপেক্ষে অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনা হবে।