পবিত্র ঈদুল ফিতর ঘিরে যখন সারা দেশের মানুষ উৎসব উদযাপনে ব্যস্ত, তখন রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে আহত শ্রমিকরা নিভৃতে সইছেন শারীরিক যন্ত্রণা। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কারণে ঈদের আনন্দ যেন ফিকে হয়ে গেছে তাদের।
ঘটনার ১০ বছরে এসে চিকিৎসা আর পুনর্বাসনের দাবি জানাচ্ছেন তারা। শ্রমিক সংগঠনের নেতারা অসহায় শ্রমিকদের মুখে হাসি ফোটাতে সংশ্লিষ্টদের সহায়তা কামনা করেছেন।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভার বাস স্ট্যান্ডে রানা প্লাজায় ভয়াবহ ধসে প্রাণ হারান ১ হাজারের বেশি শ্রমিক। ১০ বছর ধরে পঙ্গুত্ব নিয়ে এখনও বাঁচার লড়াই করছেন আরও অনেকে।
সাভারের বিভিন্ন এলাকায় বসবাস ক্ষতিগ্রস্ত এসব শ্রমিকদের। অসুস্থতা আর দারিদ্রতা নিয়ে দীর্ঘ দিন বসবাস করে আসলেও কেউ তাদের পুনর্বাসনে এগিয়ে আসেনি বলে অভিযোগ শ্রমিকদের।
শ্রমিক সংগঠনের নেতারাও রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাসহ দোষীদের শাস্তি ও শ্রমিকদের পুনর্বাসনের দাবি করে আসছেন এতদিন।
রানা প্লাজার আহত শ্রমিক তাসলিমা বেগম বলেন, মেরুদণ্ড ও পায়ে আঘাত পাইছি আমি। এত বছর ধরে কাজ করতে পারি না। অনেক কষ্টে পরিবার নিয়ে আছি। রানা প্লাজা ধসের এতদিন হয়ে গেছে আমাদের কেউ খবর নেয় নাই।
তিনি বলেন, আমরা কারও কাছে ভিক্ষা চাই না। আমাদের ন্যায্য পাওনা বুঝায় দেয়া হোক। আর কয়দিন পরেই ঈদ। সবার ঈদ আছে কিন্তু রানাপ্লাজার শ্রমিকদের আমাদের ঈদ নাই।
রানা প্লাজার সুইং অপারেটর নীলুফা বেগম ধসে পড়া রানাপ্লাজায় মারত্মক আহত। ১০ বছর ধরে বয়ে বেড়াচ্ছেন পায়ের ক্ষত। সুচিকিৎসার অভাবে ধীরে ধীরে যাচ্ছেন মৃত্যুর মুখে।
নীলুফা বেগম বলেন, রানা প্লাজা ধসে পড়ার ১০ বছর হয়ে যায়, তারপরও আমাদের কোনো খোঁজ কেউ নেয় না। আমার একটা পা মারাত্মক ভাবে আহত। ১১টা অপারেশন করা লাগছে পায়ে। পা কেটে ফেলার জন্য অনেক জায়গায় গেছি। শেষ একটা অপারেশন আছে যার জন্য ৭ লাখ টাকা লাগবে। অপারেশনের আগে ৪ লাখ টাকা জমা দেয়া লাগবে। কিন্তু ওই টাকা আমি কই পাব?
তিনি বলেন, আমি ক্ষতিপূরণ পাইছি মাত্র ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এটা কি কোনো ক্ষতিপূরণ হতে পারে? আজ পর্যন্ত বায়ার, মালিক কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের কোন খোঁজখবর কেউ রাখেনি। বিনা চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত ১৩ জন মারা গেছে।
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, আমিতো কোনো কর্ম করতে পারি না। আমি একটা পান-সিগারেটের দোকান চালাই। এটা দিয়ে ঘরভাড়া, খাওয়া সবই করতে হয়। রানা প্লাজা ভাঙ্গার পর আমি স্বামী হারাইছি। আমার চিন্তায় মাও স্ট্রোক করে মারা গেছে। ছেলে নতুন কাপড় কেনার জন্য টাকা চাইছে। কিন্তু কীভাবে দেব আমি? ছেলেটাকে পড়াতেও পারি নাই। তাহলে আমরা রানা প্লাজার শ্রমিকরা কিভাবে ঈদ করব? একটা বাড়ি নাই, ঘর নাই। আমাদের কিসের ঈদ?
বিপ্লবী গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি অরবিন্দু বেপারী বলেন, রানা প্লাজার ধসে এত শ্রমিক হতাহতের ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে দোষী ভবন মালিক সোহেল রানা। সম্প্রতি তার জামিন দিয়ে আবার স্থগিত করেছে আদালত। এই রাষ্ট্রটা সম্পূর্ণ রুটে শ্রমিকদের কর্মের বিনিময়ে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু এই শ্রমিক হত্যাকারী রানা তাকে জামিন দিয়ে দেশে একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে চায় নানা মহল। জামিনের জন্য তারা নানা জায়গায় তদবির করে। তাই সরকার ও বিচারবিভাগের কাছে আমরা রানার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাংগঠনিক সম্পাদক খাইরুল মামুন মিন্টু বলেন, রানা প্লাজার ট্র্যাজেডির ১০ বছরে এসেও আমাদের দাবি যেগুলো ছিলো তার কিছুই পূরণ হয়নি। চিকিৎসা আর পুনর্বাসনের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এবার ঈদের পরদিনেই রানাপ্লাজা ধস ঘটনার দিন। অথচ আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক পরিবারগুলো মানবেতর দিন পার করছে। ঈদের আনন্দ তাদের মাঝে নেই। তাই সরকার ও বিজিএমইএর প্রতি দাবি দ্রুত শ্রমিকদের কিছু সহায়তা দেয়া হোক।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে সাভারের রানা প্লাজা ভবন ধসে ১ হাজার ১৭৫ জন শ্রমিক নিহত হন। এ ঘটনায় ২ হাজারের বেশি শ্রমিক আহত হয়ে এখনও মানবেতর জীবনযাপন করছেন।