‘কয়েকদিন ধরে প্রচণ্ড গরম পড়ছে। সঙ্গে চলছে ধারাবাহিক বিদ্যুতের লোডশেডিং। বিদ্যুৎ না থাকলে ঘরে টিকতে পারছি না। আর গরমের কারণে বাইরেও দাঁড়াতে পারছি না।’
কথাগুলো বলছিলেন খুলনা শহরের জিরো পয়েন্ট এলাকার বাসিন্দা আসমত আলী।
গত এক সপ্তাহ ধরে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করছে দেশের খুলনা বিভাগে। গরমে স্বস্তি পেতে ওই অঞ্চলে বেড়েছে বৈদ্যুতিক পাখা ও এয়ার কন্ডিনশারের (এসি) ব্যবহার। তবে জাতীয় গ্রিড থেকে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ না হওয়ায় বিভাগ জুড়ে চলছে লোডশেডিং।
৫৫ বছর বয়সী আসমত আলী আরও বলেন, ‘আমার জীবনে কখনো এত গরম দেখি নাই। আর গত ১০ বছরের মধ্যে এত লোডশেডিং কখনো হয়নি। রমজান মাসে সবাই খুব অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়েছি।’
আবহাওয়া অধিদপ্তরের খুলনা কার্যালয় থেকে জানা গেছে, গত ২৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল রোববার দুপুরে। ওই দিন খুলনায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪৩ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
ওই অফিসের সিনিয়র আবহাওয়া কর্মকর্তা আমিরুল আজাদ বলেন, ‘২৩ বছরের মধ্যে খুলনাবাসী সর্বোচ্চ তাপমাত্রার মুখোমুখি হয়েছেন। ২৩ বছর আগের কোনো ডাটা আমাদের কাছে নেই। তাই এর আগে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা কত ছিল তা বলা যাচ্ছে না।
‘আমাদের যে ডাটা আছে, তাতে বলা যায় এই মৌসুমে খুলনায় রেকর্ড গরম পড়েছে। তবে ২০১৪ সালের এপ্রিলেও এর কাছাকাছি গরম ছিল।
‘তবে স্বস্তির খবর হলো, আজ (বুধবার) থেকে তাপমাত্রা কমতে শুরু করেছে। আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) আরও কমে যেতে পারে। সামনের সপ্তাহে ধারাবাহিক বৃষ্টির সম্ভাবনাও আছে।’
সর্বোচ্চ গরমের এই সময়ে বিদ্যুতের ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন খুলানা অঞ্চলের মানুষেরা। ওই অঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে রয়েছে ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো)।
ওজোপাডিকো সূত্র জানায়, গত এক সপ্তাহ ধরে খুলনা শহরেই চাহিদার তুলনায় দৈনিক ৩৫ থেকে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি থাকছে।
এছাড়া ওজোপাডিকোর আওতাধীন দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলা শহর, ৩৭টি পৌরসভা, দুটি সিটি করপোরেশন ও ২১টি উপজেলায় দিনের বেলা প্রায় ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে।
ওজোপাডিকোর প্রধান প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘ওজোপাডিকোর সম্পূর্ণ এলাকায় বুধবার দুপুরে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৬৯৬ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে সরবরাহ হয়েছে ৬০১ মেগাওয়াট। বাকি ৯৫ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে রয়েছে।’
বৃষ্টি কামনায় বুধবার সকালে খুলনা নগরীর শহিদ হাদিস পার্কে নামাজ আদায় করা হয়। ছবি: নিউজবাংলা
খুলনা অঞ্চলের গ্রামগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। খুলনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার মো. জিল্লুর রহমান বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের দিনের বেলা প্রায় ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুটের চাহিদা আছে। এর বিপরীতে আমরা পেয়েছি ৭০ মেগাওয়াট।
‘আমাদের আওতাধীন এই বিভাগের অন্যান্য জেলার উপজেলাগুলোতেও একই অবস্থা।’
তিনি আরও বলেন, ‘চাহিদার তুলনায় জাতীয় গ্রিড থেকে সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে। তাই সিরিয়াল করে বিভিন্ন এলাকায় লোডশেডিং দেয়া হচ্ছে।’
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অফ বাংলাদেশ লিমিটেডের (পিজিসিবি) পাবলিক রিলেশন অফিসার এ বি এম বদরুদ্দোজা খান বলেন, ‘গত এক সপ্তাহ ধরে দিনে ১৪ হাজার মেগাওয়াট ও সন্ধ্যায় ১৬ থেকে ১৭ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে। তবে কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ থাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ সরবরাহ করা যাচ্ছে না। বৃষ্টি হলে আবহাওয়া ঠাণ্ডা হবে। তখন চাহিদাও কমে যাবে। ফলে লোডশেডিংও থাকবে না।’
ঘর থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ
বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া প্রখর রোদে বাইরে বের না হওয়াসহ বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছেন খুলনার জেলা প্রশাসক মো. ইয়াসির আরেফীন।
বুধবার জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘দেশের অন্যান্য জেলার মতো খুলনা জেলার ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বহমান। এ অবস্থায় সিভিল সার্জনের সঙ্গে পরামর্শক্রমে খুলনা জেলাবাসীকে নির্দেশনাগুলো প্রতিপালনের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।
‘বিশেষ প্রয়োজন ব্যতীত প্রখর রোদে বাইরে বের না হওয়া; বিশেষ প্রয়োজনে ঘরের বাইরে বের হলে ছাতা ব্যবহারের চেষ্টা করতে হবে।’
একইসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ এবং মৎস্য অধিদপ্তরের জেলা ও উপজেলা কার্যালয় থেকে বিদ্যমান প্রতিকূল আবহাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদানে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
আঘাত শিল্প, কৃষি ও বাণিজ্যে
তীব্র লোডশেডিং জনভোগান্তির পাশাপাশি আঘাত হেনেছে দেশের শিল্প, কৃষি ও বাণিজ্য খাতে।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) পরিচালক এস হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘মাছ বা চিংড়ি যখন পানি থেকে উপরে চলে আছে তখন সঙ্গে সঙ্গে এটা সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। এটা পচনশীল দ্রব্য। আমরা হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি করি। তাই চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য প্রতি ক্ষেত্রে আমাদের বিদ্যুতের আশ্রয় নিতে হয়। মূলত চিংড়ি উৎপাদন থেকে রপ্তানি পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে বিদ্যুতের দরকার।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের যেসব কারখানা পল্লী বিদ্যুতের আওতাভুক্ত, সেখানে প্রায় ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। আর যেসব কারখানা ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের আওতাভুক্ত, তারা ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। এতে উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটছে।’
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে খুলনায় ১২ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ক্ষেতের তরমুজ বিক্রি চলছে।
দাকোপের কৈলাশগঞ্জ এলাকার কৃষক নরেন্দ্র মন্ডল বলেন, ‘এখন তরমুজ বড় করার জন্য প্রচুর সেচে দিতে হয়। এতে ফলের ওজন দৈনিক এক থেকে ২ কেজি পর্যন্ত বাড়তে পারে। তবে দিনের বেলা কোন কোন দিন ৮ ঘন্টাও লোডশেডিং হয়েছে। তাই ঠিকমতো সেচ দিতে পারছি না।’
লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পেও। শহরের সোনাডাঙ্গা এলাকায় এ্যালুমিনিয়ামের পাতিল তৈরি করেন মোদাচ্ছের আলী।
তিনি বলেন, আমার উৎপাদন সম্পূর্ণ নির্ভর করে বিদ্যুতের ওপর। তবে গত এক সপ্তাহ ধরে বিদ্যুতের কারণে উৎপাদন অনেক বেশি হ্রাস পেয়েছে।
বৃষ্টি কামনায় নামাজ
খুলনায় বৃষ্টি কামনা করে সালাতুল ইসতেস্কার আদায় করা হয়েছে। বুধবার সকালে খুলনা মহানগর ইসলামী আন্দোলনের আয়োজনে নগরীর শহিদ হাদিস পার্কে এই নামাজ আদায় করা হয়। নামাজ শেষে বৃষ্টির আশায় বিশেষ মোনাজাত করা হয়। এতে নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত মুসল্লিরা অংশ নেন।