সিলেট সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী আসন্ন নির্বাচনেও প্রার্থী হচ্ছেন কী না তা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটছে না। বরং আরিফের বিভিন্ন বক্তব্যে এ নিয়ে আরও রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে।
আরিফুল হক চৌধুরী বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সদস্য। বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্য সফরে গিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের উপস্থিতিতে এক অনুষ্ঠানে নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়ার ইঙ্গিত দেন আরিফ। তবে শনিবার যুক্তরাজ্য থেকে ফিরে আরিফ যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে তাতে আসন্ন সিটি নির্বাচনে তার স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার আভাস মিলেছে।
শনিবার দুপুরে সিলেটে ফিরে আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। তবে আমি এই জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিষয়ে অবহিত আছি। তাদের প্রত্যাশার মূল্যায়ন করব।’
আরিফের এমন বক্তব্যের পর থেকেই আলোচনা শুরু হয়েছে- নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হতে যাচ্ছেন। অবশ্য এমন গুঞ্জন চলছে দীর্ঘদিন থেকেই।
বিএনপির রাজনীতি করলেও সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা রয়েছে আরিফুল হকের। মেয়র হিসেবে প্রথম মেয়াদে সিলেট-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং দ্বিতীয় মেয়াদে সিলেট-১ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনের বিশেষ আস্থা অর্জন করেন আরিফ।
সিলেটের আওয়ামী রাজনীতিতেও অন্যতম আলোচিত বিষয় এটি। এছাড়া গত জুনে সিলেটে বন্যার ভয়াবহতা দেখতে এসে আরিফের প্রশংসা করেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গে আরিফের এই ঘনিষ্ঠতা নিয়ে বিএনপির রাজনীতিতেও কানাঘুষা ও সন্দেহ ছিলো।
এছাড়া সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিএনপি থেকে পদত্যাগ করে সংসদ সদস্য হয়েছেন উকিল আব্দুস সাত্তার। এই নির্বাচনে সাত্তারের পক্ষ নেয় আওয়ামী লীগ, যা রাজনীতিতে ‘উকিল আব্দুস সাত্তার মডেল’ মডেল হিসেবে আলোচিত হচ্ছে। এমন মডেলে সিলেটে কিছু ঘটবে কী না তা নিয়েও গুঞ্জন চলছিলো।
বিএনপি থেকে পদত্যাগ করে আরিফুল হক নাগরিক কমিটির ব্যানারে প্রার্থী হতে পারেন বলে তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজনও জানিয়েছেন। এমন আলোচনা-গুঞ্জনের মধ্যেই নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার একদিন আগে ১ এপ্রিল হঠাৎ করেই লন্ডন সফরে যান আরিফ।
যুক্তরাজ্য বিএনপির একটি সূত্রে জানা যায়, ১০ এপ্রিল তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন আরিফুল হক চৌধুরী। বৈঠকে আরিফুল হক স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করলেও তাতে রাজি হননি তারেক।
ওই সূত্র জানায়, সিটি নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়ার বদলে তারেকের কাছে সিলেট-১ আসনে দলীয় মনোনয়ন দাবি করেন আরিফুল। এছাড়া দলে ‘সম্মানজনক’ পদেরও প্রস্তাব দেন। তবে তারেক রহমান এসব ব্যাপারে আরিফুল হককে সরাসরি কোনো আশ্বাস দেননি বলে জানা গেছে।
তারেকের সঙ্গে বৈঠকের পরদিন লন্ডনের মেনর পার্ক এলাকার রয়েল রিজেন্সি সেন্টারে যুবদলের ইফতার মাহফিল ও আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে প্রথম প্রকাশ্যে কথা বলেন আরিফ। ওই সভায় আরিফুল হক বলেন, ‘আমার দল এই স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিস্ট সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না। এই সিদ্ধান্তে আমিও অটল। আন্দোলনের মাধ্যমেই আমাদের বিজয় অর্জিত হবে।’
তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের বরাত দিয়ে ওই সভায় আরিফ বলেন, ‘আমার সাথে আমার নেতার মিটিং হয়েছে। তিনি আমাকে একটা সিগন্যাল দিয়েছেন। এটা রেড নাকি গ্রিন তা সময় হলেই জানা যাবে।’
এরপর ১৬ এপ্রিল যুক্তরাজ্য থেকে সিলেটে না এসে সরাসরি ঢাকায় যান আরিফুল হক। সেখানে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে তার বৈঠকের কথা ছিল। কিন্তু ফখরুল যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকে চলে যাওয়ায় আরিফের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি। এরপর দুপুরে সিলেটে ফেরেন আরিফুল হক। ওইদিন বিমানবন্দরে তাকে বিপুল সংবর্ধনা দেন তার অনুসারী বিএনপি নেতাকর্মীরা।
এ সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না। তবে এই নগরের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিষয়ে আমি অবহিত আছি। তাদের এই আশার মূল্যায়ন আমি করবো।’
মেয়র বলেন, ‘যুক্তরাজ্যে আমাদের নেতা তারেক রহমানের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। তিনি আমাকে একটি সিগন্যাল দিয়েছেন। তিনি কী সিগন্যাল দিয়েছেন তা অচিরেই আমি খোলাসা করব। এছাড়া নির্বাচন নিয়ে আমার অবস্থানও স্পষ্ট করব।’
এ ব্যাপারে মঙ্গলবার দুপুরে আরিফুল হক চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ হলে তিনি বলেন, ‘দল নির্বাচনে না গেলেও সিলেটের জনগণ চাচ্ছেন আমি যেন প্রার্থী হই। আবার ইভিএমে ভোট সুষ্ঠু হবে কী না এ নিয়েও তাদের শঙ্কা আছে। এসব বিষয়ে দল এবং সিলেটের নাগরিক সবার সঙ্গে আলোচনা করে আমি দ্রুত একটি সিদ্ধান্ত নেব। আশা করছি ঈদের পরই আমার সিদ্ধান্ত সবাইকে জানাতে পারব।’
আরিফুল হকের প্রার্থী হওয়ার আভাস প্রসঙ্গে সিলেট মহানগর বিএনপির সভাপতি নাসিম হোসাইন বলেন, বিএনপি এই সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিএনপি কোনো নির্বাচনে যাবে না। নির্বাচনও সুষ্ঠু হবে না।
‘আরিফুল হক আমাদের দলের কেন্দ্রীয় নেতা। আশা করছি দলের অবস্থানের বিরুদ্ধে তিনি যাবেন না। তাকে অনেকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। সেই ফাঁদে তিনি পা দেবেন না বলেই আমাদের বিশ্বাস।’
সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আরিফের প্রার্থিতা প্রসঙ্গে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘আরিফুল হক প্রার্থী হতে পারেন এই প্রস্তুতি নিয়েই আমি মাঠে নেমেছি। আমি স্বাধীনতা ও উন্নয়নের প্রতীক নিয়ে প্রার্থী হয়েছি। আশা করছি জনগণ উন্নয়নের পক্ষে রায় দেবে।’
এর আগে ২০১৩ ও ২০১৮ সালে বিএনপি মনোনীত প্রাথী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মেয়র নির্বাচিত হন আরিফুল হক চৌধুরী। দুবারই তার কাছে পরাজিত হন সিলেটের সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি বদরউদ্দিন আহমদ কামরান।
নির্বাচনী তফসিল অনুযায়ী, ২১ জুন সিলেট সিটি করপোরেশনে ইভিএমে ভোট হবে। ২০০২ সালে সিলেট পৌরসভাকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত করা হয়। এই মহানগরের আয়তন ৭৯ দশমিক ৫০ বর্গকিলোমিটার, ওয়ার্ড ৪২টি। সিটি করপোরেশন হওয়ার পর এবার পঞ্চমবারের মতো নির্বাচন হতে যাচ্ছে।