বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ফেসবুক মার্কেটপ্লেসে কম মূল্যের প্রলোভনে ‘প্রতারণা’

  •    
  • ১৪ এপ্রিল, ২০২৩ ১৩:০০

যেসব পণ্যের দাম ১ টাকা লেখা থাকে, কথা বলে দেখা যায় সেগুলোর মূল্য হাজারের বেশি। বিকাশে ডেলিভারি চার্জ অথবা কিছু টাকা অগ্রিম দিতেও বলেন বিক্রেতারা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের মার্কেটপ্লেসে পণ্য ডেলিভারির নামে চলছে প্রতারণা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অগ্রিম টাকা বিকাশে নিয়ে দেয়া হচ্ছে না পণ্য।

ফেসবুক মার্কেটপ্লেসে পণ্যের পাশে ফ্রি থেকে শুরু করে অতি কম মূল্য লেখা থাকে, যা দেখে যে কেউ আগ্রহী হয়ে পণ্য কিনতে চাইতে পারেন। যেসব পণ্যের দাম ১ টাকা লেখা থাকে, কথা বলে দেখা যায় সেগুলোর মূল্য হাজারের বেশি। বিকাশে ডেলিভারি চার্জ অথবা কিছু টাকা অগ্রিম দিতেও বলেন বিক্রেতারা। যা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল কমার্স গাইডলাইন অনুসরণ করে না।

ভুক্তভোগী দাবিদারদের ভাষ্য

একটি পোশাক কারখানায় স্যাম্পল সেকশনে কর্মরত মো. আলফি বলেন, ‘আমি ফেসবুকের মার্কেটপ্লেসে দাম কম দেখে আমার বউয়ের জন্য একটা জামা অর্ডার করছিলাম। দাম লেখা ছিল ৫ টাকা। পরে চাইল ১ হাজার ৩০০ টাকা।

‘আমি দামাদামি করে ১ হাজার টাকা ঠিক করলাম। বলল ৩০০ টাকা বিকাশে অ্যাডভান্স করতে হবে। দোকানে গিয়ে তাদের নম্বরে বিকাশ করলাম। পাঁচ দিনের মধ্যে ডেলিভারি দেবে বলছিল, কিন্তু প্রায় ১ মাসেও দেয় নাই। ওই বিকাশ নম্বরও বন্ধ। এইভাবে কতজন ঠকছে কে জানে!’

একই মার্কেটপ্লেসে ‘রোজেন মুড’ নামে প্রোফাইলে একটি বিদেশি পরিবারের ছবি দেয়া বিক্রেতার সঙ্গে মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করেন আফরোজা আক্তার। সেখানে কিয়াম কোম্পানির ৭টি মারভেল কোটিং নন স্টিক সেটের মূল্য লেখা ছিল ২৬০ টাকা।

আফরোজার ভাষ্য, সেটটি কিনতে চাইলে বিক্রেতা বলেন, দাম ৩ হাজার ৪৫০ টাকা। সে সময় ২৬০ টাকা লিখে রেখেছেন কেন জানতে চাইলে মেসেজ দেখেও কোনো উত্তর দেননি বিক্রেতা।

নিউজবাংলার অনুসন্ধান

ফেসবুক মার্কেটপ্লেসে পণ্যের ডিসপ্লে মূল্যের সঙ্গে বাস্তবের এত ব্যবধানের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে অনুসন্ধানে নামে নিউজবাংলা। এর অংশ হিসেবে ক্রেতা সেজে যোগাযোগ করেন এ প্রতিবেদক।

মার্কেটপ্লেসে এক বিক্রেতা পার্টি ড্রেসের দাম লিখে রেখেছিলেন ২২০ টাকা। এ পণ্যটির বিষয়ে সজল হাকিম নামের একটি আইডিতে যোগাযোগ হয়। দাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১ হাজার ৩০০ টাকা। এরপর আবার বলেন, ‘যদি নেন ১ হাজার ১০০ টাকা রাখব।’

১ হাজার টাকা দেয়া যাবে কি না জানতে চাইলে সঙ্গে সঙ্গেই বিক্রেতা রাজি হয়ে যান। তিনি বলেন, ‘ডেলিভারি চার্জ ৮০ টাকা অ্যাডভান্স করতে হবে।’ সে সময় বারবার ২২০ টাকা লিখেছেন কেন জানতে চাইলেও বিক্রেতা কোনো উত্তর দেননি।

কোনো শোরুম আছে কি না জানতে চাইলে বিক্রেতা বলেন, ‘আমাদের এটা অনলাইন।’ পরে অ্যাডভান্স করতে বিকাশ নম্বর চাওয়া হয়। তার দেয়া বিকাশ নম্বরে যোগাযোগ করে জিজ্ঞাসা করা হয়, দাম ২২০ কেন।

তখন তিনি বলেন, ‘মার্কেটপ্লেসের এসে মানুষ বোঝে না, দাম কম দেখে ভুল করে। আসলে এগুলো সবই অফার।’

মার্কেটপ্লেসে পণ্যের ডিটেইল সেলার নাকি ফেসবুকের কেউ আপলোড করে জানতে চাইলে ওই বিক্রেতা বলেন, ‘আমরাই করি।’ তাহলে অফার না লিখে শুধু মূল্য লিখে রেখেছেন কেন জানতে চাইলে আমতা আমতা করে সজল হাকিম বলেন, ‘এরপর চেষ্টা করব।’

তিনি কোথায় আছেন জানতে চাইলে সজল বলেন, ‘আমরা মিরপুর থেকে বিজনেস করি। এখানেই আছি।’

অবস্থানে গরমিল

সজল নামের সেই বিক্রেতার নম্বরটির লোকেশন জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘ আমার বিজনেস মিরপুরে। আাম এখানেই আছি।’ নম্বরটি দেয়া হয় পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগে। সেখান থেকে জানানো হয়, ওই নম্বরের লোকেশন গাজীপুরের ভোগড়ায়। মতিঝিল ডিবির এক কর্মকর্তা একই লোকেশনের কথা জানান।

সজল হাকিমের মতো আরেকজন বিক্রেতা শুভ ঘোষ, যিনি ভ্যানিটি ব্যাগ বিক্রি করেন ফেসবুক মার্কেটপ্লেসে। ব্যাগের দাম লেখা ১ টাকা। শুভর আইডিতে প্রোফাইল ও কাভারে মুখ দেখা যায় না, এমন দুই মেয়ের ছবি।

সেখানে মেসেঞ্জারে কল দিলে একটি মেয়ে রিসিভ করেন। তারা কোথায় বিজনেস করেন জানতে চাইলে বলেন, ‘পুরান ঢাকা।’ পরে তার লোকেশন পাওয়া যায় নাটোর।

ব্যাগের দাম ১ টাকা লিখেছেন কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসল দাম দেইনি তাই।’

‘এতে মানুষ বিভ্রান্ত হবে। আসল দাম না দিলে কোনো দামই দেবেন না, কিন্তু ১ টাকা কেন?’

উল্লিখিত প্রশ্নের উত্তরের শুভ লিখেন, ‘এটা নিয়ম। আপনি বুঝবেন না। তাই না বুঝেই কথা বলবেন না।’

পরে ব্যাগটি কেনার প্রক্রিয়া জানতে চাইলে বিকাশে ১৫০ টাকা অগ্রিম চার্জ দিতে হবে বলে জানান। সেই নম্বরে কল করা হলে রিসিভ করেন এক নারী।

শুভর আইডি কার জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আমার আইডি।’ ছেলের নামে আইডি কেন, তা জানতে চাইলে এই প্রশ্ন তিনি এড়িয়ে যান বারবার। তাদের পেজ থেকেই এভাবে কম মূল্য লেখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলেও জানান মেয়েটি। নিজের নাম দোলা ঘোষ বলে পরিচয় দেন তিনি।

আর শুভ ঘোষের আইডি থেকে যে মেয়েটির সঙ্গে কথা হয়, সে তার লোকেশন জানায় পুরান ঢাকা। থানা থেকে ট্র‍্যাক করে জানা যায়, তার অবস্থান নাটোরে। বাকি যে নম্বরগুলোর সঙ্গে কথা হয়, সেগুলো বন্ধ পাওয়া যায়।মো. বনি নামের এক সেলার ব্যাগের দাম লিখে রাখেন ৭ টাকা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ক্রেতার সঙ্গে অসদাচরণ করে বলেন, ‘ব্যাগের দাম ৭ টাকা? আপনার শ্বশুরে দেবে? নিলে নেন, না হলে নিয়েন না। এটা কোড নম্বর।’

টাকা কীভাবে কোড নম্বর হয় বললে তিনি রেগে যান। পরে তাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে কেনার প্রক্রিয়া জানতে চাইলে অ্যাডভান্স ৮০ টাকা চান।

বিকাশ নম্বর পেয়ে কল দিয়ে কৌশলে জেনে নেয়া হয় তারা কেন এই দাম লিখে রাখেন।

বনি বলেন, ‘এই কম দাম দেখলে কাস্টমাররা ক্লিক করবে। প্রতি ক্লিকে আরও বেশি জনের কাছে এটা রিচ করবে। ১০০ জন ক্লিক করলে ১০ জন তো কিনবে। এটা না করলে তো ক্লিক বাড়বে না। এটা আমাদের পলিসি।’

এতে বেশিরভাগ ক্রেতা বিভ্রান্ত হতে পারেন বললে তিনি চুপ করে থাকেন। পরে তাকে ডেলিভারি চার্জ বিকাশে পাঠিয়ে প্রোডাক্ট কবে দেবেন জানতে চাইলে কোনো রেসপন্স আসে না।

আরেকটি ডিনার সেটে অফার চলছে দেখে নক দেয়া হয়। সেখান থেকে এ রকম একটি অটো টেক্সট আসে- ‘ডিনার সেট ৩২ পিস মাত্র ৮০০ টাকা; অফার সীমিত সময়ের জন্য কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে। হোম ডেলিভারি পণ্যটি নিতে আপনাকে যা করতে হবে। ডেলিভারি খরচ আগে দিয়ে অর্ডার কনফার্ম করতে হবে এবং বাকি টাকা পণ্য হাতে পেয়ে দিবেন। ঢাকার ভিতরে ১০০ টাকা ঢাকার বাহিরে ১৫০ টাকা ডেলিভারি চার্জ বিকাশ করতে হবে। বিকাশ পার্সোনাল (01704334900) আপনি চাইলে আমাদের দোকানে এসে নিতে পারেন। ঢাকা নিউমার্কেট ৪ নং গেইট থেকে ঢুকে বলবেন দোকানের নাম এশা মনি ডিনার শোরুম, দোকান নং ০১৩।’

নিউ মার্কেটে গিয়ে এই নামে কোনো ডিনার সেটের দোকানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।

একজন ক্রোকারিজ বিক্রেতা বলেন, ‘সকাল থেকে অন্তত ২০ জন এই নামে দোকান খুঁজেছে, কিন্তু আমরা কেউ বলতে পারিনি। কোনো দোকান নেই এই নামে।’

নিউ মার্কেটের চার নম্বর গেটের পাশের কাপড় বিক্রেতা বলেন, ‘চার নম্বর গেটের আশেপাশের পুরো এরিয়ায় কোনো ডিনার সেটের দোকান নেই এবং সেটি দেখাও যায়।’

যে নম্বর দেয়া আছে তাতে অনেকবার কল করেও কাউকে পাওয়া যায়নি।

ফেসবুকের বিধি কী বলছে

ফেসবুকের মার্কেটপ্লেস এর বিধিতে বলা হয়, ‘একটি পণ্য কেনার আগে আমরা ক্রেতাদের দাম তুলনা করতে বলি। লেনদেন সম্পন্ন হওয়ার পর বিক্রেতা শিপিংয়ের জন্য অতিরিক্ত চার্জ করার অনুরোধ করলে সম্মত হওয়া যাবে না।’

এতে আরও বলা হয়, ‘যে পণ্যটি কিনছেন, তা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে আসল কি না।’উচ্চমূল্যের ঘড়ি, বিলাসবহুল ব্যাগ কেনার প্রমাণ হিসেবে প্রয়োজনীয় কাগজ বা রসিদ চাওয়ার কথা বলা হয়েছে বিধিতে।

যা বলছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়

বানিজ্য মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. হায়দার বলেন 'ডিজিটাল মার্কেটিং এর জন্য আমাদের কিছু গাইডলাইন আছে। যারা নিবন্ধিত অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তারা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে পণ্য বিক্রি করতে পারবে। এখন ফেসবুকের মাধ্যমে হাজার হাজার বিক্রেতা পণ্য বিক্রি করছে।'

তারা পণ্যের দাম কম লিখে বেশি দামে বিক্রি করছে এমনকি অ্যাডভান্স নিচ্ছে। এই প্রশ্নে তিনি বলেন 'আমাদের ডিজিটাল ট্রেড এর গাইডলাইনে এরকম কোনো বিধান নেই যে দাম একটা লিখবে আর আরেকটা চাইবে। এটা তো চলতে পারে না। তাদেরকে সঠিক সিস্টেমের আওতায় আনার জন্য আমি কথা বলবো।'

বানিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল কমার্স গাইডলাইন

পুলিশের ভাষ্য

সাইবার ক্রাইম তদন্ত বিভাগের এ্যাসিসট্যান্ট ডেপুটি কমিশনার (এডিসি) নাজমুল ইসলাম বলেন, অনলাইন মার্কেটপ্লেসে প্রতারণার বিভিন্ন রকমফের আছে। প্রত্যেক ধরণের প্রতারণা নিয়েই পুলিশ কাজ করছে। বিশেষ করে সাইবার তদন্ত বিভাগ। আমরা মনিটর করছি। মনিটর করে এ ধরনের প্রতারণার সঙ্গে জড়িত অনেককে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছি। টিম কাজ করছে।

‘সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ থাকলে আমাদের আরও বেশি সুবিধা হবে কাজ করতে। যারা ভুক্তভোগী তাদেরকে আহবান করবো পুলিশকে রিপোর্ট করতে। বিশেষ করে সাইবার পুলিশকে রিপোর্ট করবে। আমরা যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নিবো’

ফেসবুক মার্কেটপ্লেসে পণ্য বিক্রিতে নানা অসঙ্গতি নিয়ে জানতে চাইলে মতিঝিল ডিবির কর্মকর্তা বলেন, ‘এরা তো ফ্রড। লোকেশন বলছে মিরপুর, দেখা যাচ্ছে ভোগড়া, গাজীপুর। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে কাজ করতে হবে। আমরা এটা নিয়ে দ্রুতই কাজ শুরু করব।’শেরেবাংলা নগর থানার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি সাইবার ক্রাইম ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে কথা বলব। এটা কোনো চক্র কি না সেটা দেখা অবশ্যই জরুরি।’

ওই কর্মকর্তাকে জানানো হয়, দাম কম লিখে গ্রাহককে বিভ্রান্ত করা এবং পণ্য ডেলিভারি না দিয়ে যার কাছে যা পারছে অ্যাডভান্স নিচ্ছে কথিত বিক্রেতারা। যতজন সেলারের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে, তাদের প্রত্যেকটি ফেসবুক আইডি ভুয়া মনে হয়েছে।

এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হবে।’

এ বিভাগের আরো খবর