চলে গেলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। একই সঙ্গে অবসান হলো বীর মুক্তিযোদ্ধা, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও গণবিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় ওষুধ নীতির এক রূপকারের কর্মময় বর্ণাঢ্য জীবনের।
রাজধানীর গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে মঙ্গলবার রাতে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ক্ষণজন্মা মানুষটির বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।
গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের প্রধান কিডনি বিশেষজ্ঞ ও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রধান চিকিৎসক অধ্যাপক মামুন মোস্তাফী মঙ্গলবার রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুর খবর আনুষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিকদের জানান।
মামুন মোস্তাফী বলেন, ‘আমাদের প্রাণপ্রিয় ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ভাই আর আমাদের মাঝে নেই। দেশবাসীর কাছে অনুরোধ, আপনার তার জন্য দোয়া করবেন।’
দীর্ঘদিন কিডনি রোগসহ বিবিধ স্বাস্থ্যগত জটিলতায় ভুগছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। মৃত্যুকালে তিনি রেখে গেছেন তার সহধর্মিণী নারীনেত্রী শিরীন হক ও দুই পুত্র-কন্যাকে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের এক দিশারী ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। গণমুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। জনস্বার্থ কেন্দ্রে রেখে জাতীয় ওষুধ নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে তার উদ্যোগ, সমাজভিত্তিক জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির রূপরেখা হাজির করা দেশপ্রেমিক হিসেবে তার অবদানের একেকটি মাইলফলক। জাতীয় দুর্যোগ ও রাজনৈতিক সংকটে তিনি সর্বদাই নির্ভীক থেকে সত্য বলে গেছেন, প্রতিবাদী হয়েছেন, পথ দেখিয়েছেন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর আবির্ভাব ছিল নাটকীয় ও বীরত্বপূর্ণ। ১৯৭১ সালে বিলেতের অভিজাত প্রতিষ্ঠান থেকে সার্জন হওয়ার সুযোগ ছিঁড়ে ফেলে তিনি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সেই ঘটনা দেশ-বিদেশে স্মরণীয় হয়ে আছে।
তিনিই আবার রণাঙ্গনের একটু পেছনে ত্রিপুরা সীমান্তে প্রতিষ্ঠা করেন মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল। সেটাই প্রথম কোনো হাসপাতালের নামে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটা যুক্ত হয়। সেই যুদ্ধ হাসপাতালই স্বাধীন বাংলাদেশে গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল নামে এখনও সেবা দিয়ে যাচ্ছে। শুধু নিজেকেই দেশের সেবায় নিয়োজিত করেননি, উদ্বুদ্ধ করেছেন আরও একগুচ্ছ মানুষকে। আজকের বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের উজ্জ্বল অনেক মানুষই ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রেরণা, তাগাদা এবং দিশা ধরে দেশকে এগিয়ে দিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধের ক্রান্তিকালে জাফরুল্লাহ চৌধুরী নিজেকে আবিষ্কার করেছিলেন দেশের একনিষ্ঠ সেবক হিসেবে। তিনিই আবার স্বাধীন দেশে হয়ে উঠলেন স্বাস্থ্যসেবা, নারী প্রগতি, গ্রামমুখী পেশাদারি বিকাশের নায়ক।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী আশির দশকে নামলেন ওষুধ শিল্পে নয়ছয় ঠেকাতে জাতীয় ওষুধ নীতি প্রণয়ন করতে। অনেক হামলা ও বাধা ডিঙিয়ে তা পাস করালেন। জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিও সরকারকে নিয়ে করিয়ে নিয়েছিলেন, কিন্তু সেটা আর বাস্তবায়ন হয়নি, তবে ওষুধ নীতির কল্যাণে ওষুধের দাম গরিবের নাগালে এসেছিল। ওষুধ শিল্প দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
যুদ্ধকালে তার প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও প্যারামেডিকের ধারণা পরে বিশ্বায়িত হয়। ওষুধ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তিনি শুধু লড়াইই করেননি, অসাধারণ একটা বই লিখেছেন ‘দ্য পলিটিকস অফ এসেনসিয়াল ড্রাগস’ নামে। জনস্বাস্থ্য যে গণরাজনীতির কেন্দ্রে থাকা উচিত, সেই প্রশ্নটি তিনি শেখালেন।
জীবন সায়াহ্নে এসে বাংলাদেশসহ বিশ্বই যখন কোভিড-১৯ অতিমারির ভয়াল থাবার নিচে, সে সময় তিনি আবার দাঁড়ালেন করোনাভাইরাস পরীক্ষা, প্রতিরোধ ও প্রতিকারের গবেষণাকাজে। তার এই দায়িত্বশীল উত্থান বহু মানুষকে আশা দিয়েছে, অভয় দিয়েছে। যেমন: দেশের কিডনি রোগীদের এক বড় ভরসাস্থল হয়ে আছে তার প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম ডায়ালাইসিস সেন্টার। তার প্রতিষ্ঠিত গণবিশ্ববিদ্যালয় অনেক নিপীড়িত, অভাবী ও প্রান্তিক শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষার ভরসা হয়ে আছে।
ডা. জাফরুল্লাহ বৈশ্বিক স্তরে স্বাস্থ্যসেবার ধারণায় পরিবর্তন এনেছেন। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ধারণা তিনিই প্রথম সামনে আনেন। ডাক্তারি শাস্ত্রে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াও সাধারণের পক্ষে প্যারামেডিক হওয়ার পথ দেখিয়ে তিনি স্বাস্থ্যসেবাকে মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছেন। তার এই দুটি ধারণা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জাতিসংঘসহ অনেক উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ নিয়েছে। সেই দিক থেকে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অবদান শুধু সর্বজনীন নয়, বিশ্বজনীনও।
জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জন্ম ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায়। তার বাবার শিক্ষক ছিলেন বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেন। মা-বাবার ১০ সন্তানের মধ্যে তিনি সবার বড়।
ঢাকার বকশীবাজারের নবকুমার স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট উত্তীর্ণের পর তিনি ১৯৬৪ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস এবং ১৯৬৭ সালে বিলেতের রয়্যাল কলেজ অফ সার্জনস থেকে এফআরসিএস প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
পুরস্কার ও সম্মাননা
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ১৯৭৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার পান। এ ছাড়া তিনি ফিলিপাইন থেকে র্যামন ম্যাগসাইসাই (১৯৮৫) এবং সুইডেন থেকে বিকল্প নোবেল হিসেবে পরিচিত রাইট লাভলিহুড (১৯৯২), যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ইন্টারন্যাশনাল হেলথ হিরো’ (২০০২) এবং মানবতার সেবার জন্য কানাডা থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পান। ২০২১ সালে তিনি পান আহমদ শরীফ স্মারক পুরস্কার।