বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

চট্টগ্রামে শিশু নিপীড়ন বাড়ছে, আতঙ্কে কর্মজীবী বাবা-মা

  •    
  • ৬ এপ্রিল, ২০২৩ ২২:১৮

চট্টগ্রামে গত ৭ মাসে শিশু খুনের ঘটনা ঘটেছে কমপক্ষে চারটি। হত্যার শিকাররা সবাই কন্যা শিশু। একই সময়ে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৮টি। হত্যা-ধর্ষণের শিকার এসব শিশুর পরিবারে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মা-বাবা উভয়ে নিম্নবিত্ত কমজীবী। একাকী বাসায় থাকা শিশুরা হত্যা, ধর্ষণসহ নানা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

চট্টগ্রামে বাড়ছে শিশুদের প্রতি নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনা। একের পর এক খুন হচ্ছে শিশু। গত ৭ মাসে চট্টগ্রামে শিশু খুনের ঘটনা ঘটেছে কমপক্ষে চারটি। হত্যার শিকাররা সবাই কন্যা শিশু। একই সময়ে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৮টি।

পুলিশের তথ্যমতে, ওই চার শিশুর তিনটিই হত্যার আগে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। আবার প্রতিটি ঘটনাই ঘটেছে চট্টগ্রাম শহর এলাকায়। এই চার শিশুর মধ্যে দুটির মা ঘটনার সময় বাসায় থাকলেও বাকি দুটি শিশুর মায়েদের একজন গার্মেন্ট কর্মী ও অন্যজন ভিক্ষাবৃত্তি করেন।

এই একই সময়ে চট্টগ্রামে কন্যা শিশু ধর্ষণের ৮টি ঘটনা গণমাধ্যমে এসেছে৷ এর মধ্যে ৩ টি ঘটেছে শহরে৷ এই ৩ শিশুর মা-বাবাও কর্মজীবী। তাদের প্রায় সবাই তৈরি পোশাক কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন।

একের পর শিশুর প্রতি নিপীড়নের ঘটনায় উদ্বেগ ও আতঙ্কের সৃষ্টি করছে সাধারণ মানুষের মনে৷ অন্যদিকে নিপীড়নের শিকার শিশুদের অধিকাংশের বাবা-মা নিম্ন আয়ের কর্মজীবী হওয়ায় এসব ঘটনা শ্রমজীবী মা-বাবার মধ্যে বাড়তি আতঙ্ক সৃষ্টি করছে।

নিম্নবিত্ত কর্মজীবী বাবা-মায়েরা দিনের অধিকাংশ সময় বাসার বাইরে থাকেন। আর এই পুরো সময়টা শিশুকে একাকী বাসায় থাকতে হয়। এ অবস্থায় পরিচিত বা স্বল্প পরিচিতদের কেউ কেউ যৌন হেনস্তা করছে কন্যা শিশুদের। অনেক ক্ষেত্রে তা ধর্ষণ এমনকি হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত গড়াচ্ছে।

অপরাধ বিজ্ঞানীদের মতে, কর্মজীবী মায়েরা সারাদিন বাইরে থাকায় শিশুরা বাসায় একা ও অরক্ষিত অবস্থায় থাকে৷ এটাকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে চারপাশে ভালো মানুষের ছদ্মবেশে থাকা কিছু আড়ালে মানসিক বিকারগ্রস্থ ব্যক্তি তৎপর হয়ে ওঠে। তারা অনেকটা অরক্ষিত এসব শিশুর ওপর নিপীড়ন চালায়।

গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম নগরীর বন্দর থানার পোর্ট কলোনি এলাকার একটি পরিত্যক্ত বাসা থেকে ৭ বছর বয়সী সুরমার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে ওসমান হারুন মিন্টু নামে এক রিকশাচালককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ওই শিশুর বাবা রিকশাচালক ও মা ভিক্ষাবৃত্তি করেন। বিরিয়ানির লোভ দেখিয়ে শিশুটিকে ডেকে নিয়ে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করে মিন্টু।

১৫ অক্টোবর খুলশি থানার ঝাউতলা এলাকায় খাবারের লোভ দেখিয়ে ৮ বছর বয়সী কন্যা শিশুকে ধর্ষণের দায়ে খাবার হোটেল মালিক নজির আহম্মদকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

এর ১০ দিন পর নগরীর জামালখান এলাকায় নিখোঁজ হয় ৭ বছর বয়সী মারজানা হক বর্ষা। নিখোঁজের ৩ দিন পর একই এলাকার সিকদার হোটেলের পাশের নালা থেকে শিশুটির বস্তাবন্দি মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় মিন্টু নামের এক দোকান কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

এর এক সপ্তাহ না পেরুতেই ২ নভেম্বর নগরীর আকবর শাহ থানার কর্নেল হাট জোন্স রোড এলাকায় ধর্ষণের শিকার হয় ৫ বছর বয়সী আরেক কন্যা শিশু। এ ঘটনায় আলমগীর খান নামে এক রিকশাচালককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

এরপর ১৫ নভেম্বর নগরীর ইপিজেড এলাকায় বাসার পাশে আরবি পড়তে গিয়ে নিখোঁজ হয় ৫ বছর বয়সী আলিনা ইসলাম আয়াত৷ ৯ দিন পর ঘটনায় জড়িত সন্দেহে আবির নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মুক্তিপণের জন্য আয়াতকে অপহরণের পর হত্যার স্বীকারোক্তি দেয় আবির।

ওই একই মাসের শেষ দিকে ২৭ নভেম্বর নগরীর বাকলিয়া থানা এলাকায় বাসায় বাবা-মা না থাকার সুযোগে পৌনে ২ বছর বয়সী কন্যশিশুকে ধর্ষণ করে পার্শ্ববর্তী ভবনের নিরপত্তা প্রহরী দুলাল। এ সময় শিশুর ৭ বছর বয়সী ভাইকে কৌশলে দোকানে পাঠিয়ে দেয় অভিযুক্ত ব্যক্তি। পরদিন শিশুর মায়ের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্ত দুলালকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

সবশেষ ২১ মার্চ নগরীর পাহাড়তলী এলাকার বাসা থেকে আরবি পড়তে গিয়ে নিখোঁজ হয় ১০ বছর বয়সী আবিদা সুলতানা আয়নী ওরফে আঁখি মনি। ঘটনার ৮ দিন পর একই এলাকা থেকে তার বস্তাবন্দি মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় রুবেল নামে এক সবজি বিক্রেতাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

চট্টগ্রামে শিশুদের প্রতি একের পর এক এসব নিপীড়নের ঘটনায় আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন নিম্নবিত্ত কর্মজীবী বাবা-মায়েরা। নগরীর রৌফাবাদ এলাকায় কথা হয় গার্মেন্ট কর্মী জসীমের সঙ্গে। এক কন্যার জনক জসীমের স্ত্রীও গার্মেন্টকর্মী। ১২ বছর বয়সী শিশু কন্যাকে প্রতিদিন বাসায় একা রেখেই কর্মস্থলে যেতে হয় তাদের।

নিউজবাংলাকে জসীম বলেন, ‘যে অবস্থা চলতেছে, আমরা সন্তান একা বাসায় রেখে গিয়ে সবসময় দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকি। ছেলে সন্তান হলে খুব বেশি সমস্যা নেই। কিন্তু আমার মেয়েকে সবসময় বাসায় একা রেখেই যেতে হয়।

‘চাকরি না করলে তো খেতে পারব না। এখন শহরে একের পর এক যে ঘটনাগুলো ঘটছে, ফেসবুক ও টিভিতে দেখলে ভয় লাগে। এগুলো আমাদের মনের ভয় আর দুশ্চিন্তাটা বাড়িয়ে দেয়। সবসময় ভয় হয়, সন্তানটা বিকারগ্রস্ত কার‌ো চোখে পড়ে যায় কি না। সারাদিন কাজ করলেও মন পড়ে থাকে বাসায়।’

এ বিষয়ে কথা হয় অপরাধ বিজ্ঞানী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের অপকর্ম বা বীভৎস কর্মের প্রধান কারণ হচ্ছে আমাদের পরিবার গঠনের প্রক্রিয়া সঠিক পন্থায় যাচ্ছে না। আমরা সন্তান জন্ম দিচ্ছি ঠিকই, কিন্তু এরপর ওদের বেড়ে ওঠার যে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া সে প্রক্রিয়া অনুসরণ করছি না। যথার্থ নীতি-নৈতিকতা, শিক্ষা বা আমরা যেগুলো বলি সামাজিক শিক্ষা- যা মানুষের আচরণকে সংযত করে, সুসংহত করে, সে বিষয়গুলো আমরা পরিবার থেকে আমাদের ছেলে-মেয়েদের দিতে পারছি না।

‘পরিবার হচ্ছে শিশুর প্রথম ও প্রধান শিক্ষাঙ্গন। মিনিমাম ৬ বছর পর্যন্ত পরিবার থেকেই তারা প্রথম শিক্ষা পায়। তারা যখন স্কুলে যাচ্ছে, সেখানেও তাদের ন্যূনতম নীতি-নৈতিকতা বা আরেকজনের প্রতি সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, শ্রদ্ধা, ভালোবাসার বিষয়গুলো কী জিনিস সেগুলো আমরা ওদের শিক্ষা দিচ্ছি না৷

‘আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় পাঠদান প্রক্রিয়া ও বইয়ের কনটেন্টগুলোতেও ছোটবেলা থেকে নীতিনৈতিকতা বা হৃদয়ের গভীরে কোনো কিছু হবে- এমন কিছু নেই।’

অপরাধীরা আইনের ফাঁক-ফোকরে পার পেয়ে যাওয়াকে দোষেন এই অপরাধ বিজ্ঞানী। বলেন, ‘যারা এই বীভৎস ভয়ঙ্কর অপকর্মগুলো করছে, তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসছি আমরা। কিন্তু আইনের অসংখ্য ফাঁকফোকর ও আইনসংশ্লিষ্ট কতিপয় অর্থলোভী মানুষের সাহায্যে অল্প শাস্তির পর দুই-চারদিনের মধ্যে ওরা জামিন পেয়ে যায়।

‘এক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যায় নিম্নবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্তরা আদালতে দৌড়াতে পারেন না। এ ধরনের ভুক্তভোগীরা আইনের সুরক্ষা কতটা পাচ্ছে তা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। শিশু-কিশোরদের প্রটেক্ট করার জন্য প্রয়োজনে আইনের প্রক্রিয়া ও প্রয়োগ সংশোধন করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘শিশু-কিশোরদের রক্ষা করার জন্য, অপরাধীদের আইনের সত্যিকার কঠোর কাঠামোয় আনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে না পারলে সামনের দিনগুলোতে আরো কঠিন কিছু হয়তো আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে৷’

এসব ঘটনা বন্ধে অপরিকল্পিত নগরায়ন বন্ধের দিকে জোর দেয়ার তাগিদ দেন তিনি। বলেন, ‘নিপীড়নের শিকার শিশুদের অধিকাংশই দরিদ্র বা নিন্মবিত্ত পরিবারের৷ কেউ কেউ কর্মজীবী শিশু-কিশোর, কেউ বস্তিতে থাকে। তাদের জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রতিটি অলি-গলিতে, প্রত্যেক জেলা-উপজেলায় এমন সব প্রতিষ্ঠান থাকা দরকার যেখানে ওই শিশুদের জন্য ওরিয়েন্টেশনের ব্যবস্থা থাকবে।’

প্রশ্ন তুলে এই অপরাধ বিজ্ঞানী বলেন, ‘এই যে নিম্ন আয়ের কর্মজীবী বাবা-মায়ের সন্তান ধর্ষণ, হত্যা, নির্যাতনে শিকার হচ্ছে, এই পরিবার শহরমুখী কেন হল? এটা হয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়নের নিকৃষ্টতম কর্মজজ্ঞের কারণে।

‘শহরে যত গার্মেন্টস পল্লী আছে, সেগুলো কেন আমরা গ্রামে করছি না? গ্রামাঞ্চলে কারখানাগুলো করলে তো এই মানুষগুলো শহরমুখী হবে না। আমাদের কৃষিতে আরও নজর দিতে হবে। মানুষ যেন শহরমুখী না হয় সে ব্যবস্থা নিতে হবে। কেননা আমরা যত শহরমুখী হচ্ছি তত বেশি দুর্বৃত্তায়নের শিকার হচ্ছি।’

এ বিভাগের আরো খবর