ঢাকার সাভারে ভাড়া বাসা থেকে প্রথম আলোর এক সাংবাদিককে আটকের খবর পাওয়া গেছে।
উপজেলার আশুলিয়ার আমবাগান এলাকার বাসা থেকে বুধবার ভোররাতে ওই সাংবাদিককে ‘আটক’ করা হয়।
আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রাজু মন্ডল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওখানে সিআইডির এক এসপি স্যার ছিলেন। ওখানে আমাকে জাস্ট উনারা প্রেজেন্ট থাকতে বলছে। পোশাক পরিহিত পুলিশ হিসেবে আমাকে রাখছে। এটা খুব সিকিউরড করে ধরা হয়েছে। এডিশনাল এসপি স্যার আসছিলেন চারজন। কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ ছিল না।
‘কাকে ধরতে আসছে, কাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, এটা সম্বন্ধে আমি জানিই না। আসলে কোন ব্যাপারে তাকে কেন ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, আমি জানি না। পরে আপনাদের স্থানীয় এক সাংবাদিক একটু বলল।’
মো. শামসুজ্জামান সাভারে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক হিসেবে কর্মরত। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৫তম আবর্তনে বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন। তার গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের কৃষ্ণপুরে।
শামসুজ্জামান গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় নিহত এসপি রবিউল ইসলামের ভাই। তিনি সাভারের আমবাগান এলাকায় ভাড়া বাসায় একাই থাকতেন, তবে মঙ্গলবার রাতে আরিফুল ইসলাম নামে এক সাংবাদিক শামসুজ্জামানের বাসায় ছিলেন, যিনি ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন বলে জানিয়েছেন।
সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমি সাভার-ধামরাইয়ে সাংবাদিকতা করছি। মাঝেমধ্যে অফিসের কাজে ঢাকা যাই। গতকাল (মঙ্গলবার) ঢাকা গিয়েছিলাম। ফেরার পথে বেশি রাত হওয়ায় ভাইয়ের বাসায় আসি কাল সকালে আবার ঢাকা যাব এ জন্য।’
আরিফ আরও বলেন, “আমি রাতে ঘুমিয়েছিলাম। ভোর ৪টার দিকে শামস ভাই আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। উঠে দেখি, ডাইনিংয়ে পাঁচ/ছয় ব্যক্তি দাঁড়ানো। আর এক ব্যক্তি ভাইয়ের কক্ষে তল্লাশি করে তার ব্যবহৃত একটি ল্যাপটপ, দুটি মুঠোফোন ও একটি পোর্টেবল হার্ড ডিস্ক নিয়ে নেয়। বাইরে থাকা একটি ব্যাগ ফাঁকা করে সেই ব্যাগে ওসব ঢুকাচ্ছে। এরপর কর্মকর্তা গোছের একজন ঘরের ভিতরে ঢুকে আমার কাছে পরিচয় জানতে চায়। বলে, জিজ্ঞাসাবাদ করবে। তারপর বাসায় দিয়ে যাবে।
“সিআইডি পরিচয়দানকারী এদের মধ্যে একজন বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বলছিলেন, ‘নিউজ দিয়ে রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করছে। সেটাই শুনব।’ তাদেরই একজন শামস ভাইয়ের প্রয়াত বড় ভাই রবিউলের কথা বলেন। উনি তো এসি রবিউলের ছোট ভাই। এরপর ১০-১৫ মিনিট অবস্থান করার পর তারা বাসা ছেড়ে চলে যায়।’
ওই সাংবাদিক আরও বলেন, ‘এর ৪৫ মিনিট পর তারা আবার শামসুজ্জামান ভাইকে নিয়ে বাসায় আসেন। এ সময় তারা জব্দ করা মালামালের তালিকা করেন। শামসুজ্জামানকে জামাকাপড় নিতে বলা হয়। এ সময় কক্ষের ভেতরে দাঁড় করিয়ে তার ছবি তোলা হয়। পাঁচ/সাত মিনিটের মধ্যে আবার তারা বের হয়ে যান। বাসা তল্লাশির সময় দুইবারই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহীন উপস্থিত ছিলেন।’
প্রত্যক্ষদর্শী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, ক্যাম্পাসে বটতলার নূরজাহান হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহীন, একজন নিরাপত্তা প্রহরী, শামসুজ্জামানসহ মোট ১৯ জন ব্যক্তি সেহরির খাবার খান। ভোর পৌনে ৫টার দিকে বটতলা থেকে তারা আবার শামসুজ্জামানের বাসায় যান। শামসুজ্জামানের বাসার সামনে থাকা দুটি গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছিল ঢাকা মেট্রো চ ৫৬-২৭৪৭ ও ঢাকা মেট্রো জ ৭৪-০৩৩১। আরেকটিতে কোনো নম্বর প্লেট দেখা যায়নি। দ্বিতীয়বার বাসায় যাওয়ার সময় আশুলিয়া থানার এসআই রাজু সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
শামসুজ্জামান যে বাসায় থাকতেন, সে বাড়ির মালিক ফেরদৌস আলম কবির বলেন, ‘শামসুজ্জামান নিচ তলায় এক বছর আগে বাসা ভাড়া নেয়। ওই একমাত্র ব্যাচেলর ছিল। গুলশানে হলি আর্টিজানে ওর ভাই রবি শহীদ হয়েছেন। সে হিসেবেই ওর প্রতি আলাদা মায়া ছিল আমার, যে কারণে ওরে বাসা ভাড়া দিয়েছি।
‘গতকাল রাতে সিআইডি পরিচয়ে ৫-৭ জন বাসায় এসেছিল। তাদের আচরণ পেশাদার ছিল। শামসকে নিয়ে তারা ভোর ৪টার দিকে বের হয়ে যায় একসাথে সেহরি খাওয়ার কথা বলে। পরে শামসকে নিয়ে তারা আবার আসছে। কাপড়চোপর আর ফোন ও ল্যাপটপজাতীয় ডিভাইসগুলো নিয়ে গেছে। আমি তাদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, আসলে কী ব্যাপার। তারা বলেছে, উনি একটা নিউজ করেছিল। সেটার প্রেক্ষিতে একটা মামলা হয়েছে।’
তিনি আরও জানান, যারা সিআইডি পরিচয়ে এসেছিল, তাদের সাথে শামসের আচরণও অস্বাভাবিক মনে হয়নি। মনে হচ্ছিল তারা পূর্ব পরিচিত।
সিআইডির ভাষ্য
সিআইডি ঢাকা বিভাগের ডিআইজি মো. ইমাম হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকা বিভাগ কাউকে আটক করেনি।’
সিআইডি সদরদপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আজাদ রহমান বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই।’
সিআইডি ঢাকা মেট্রোর দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের ঢাকা মেট্রোর কেউ আটক করলে বিষয়টা জানতাম। সিআইডির নাম করে অন্য কেউ করেছে কি না, বিষয়টা জানি না।’
যা বললেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
এদিকে সচিবালয়ে বুধবার এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘আইন নিজস্ব গতিতে চলে। আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রসহ সব চলে। কেউ যদি সংক্ষুব্ধ হয়ে বিচার চায়, থানায় মামলা করে, সে অনুযায়ী পুলিশ কিন্তু ব্যবস্থা নিতেই পারে, আমি যতটুকু জানি, একটা মামলা রুজু হয়েছে। সেই জন্য সিআইডি...।’
মন্ত্রী বলেন, ‘আমার কাছে সব রিপোর্ট আসেনি। আমি যতটুকু অবগত হয়েছি, এই মামলাকে কেন্দ্র করে খুব সম্ভব কিছু একটা ঘটেছে, এখনও পরিষ্কার নই।’
স্বাধীনতা দিবসে প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদন নিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘তবে প্রথম আলোর সাংবাদিক সাহেব যেটা করেছেন, এটা সঠিক ছিল না, যেটা নাকি একাত্তর টিভির মাধ্যমে আপনারাই প্রচার করেছেন। আপনারাই সাংবাদিক ভাইরা সংক্ষুব্ধ হয়ে একাত্তর টিভির মাধ্যমে এই সংবাদটা যে ভিত্তিহীন, মিথ্যা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এটা ছাপানো হয়েছে, একাত্তর টিভিতে এটা সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।’