সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেখে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছিলেন জাকির হোসেন। এরপর নিজেও নেমে পড়েন একই পথে। ফ্রিল্যান্সারদের টার্গেট করে ডলার বেচাকেনার নাম করে শুরু করেন প্রতারণা। এভাবে গত প্রায় দেড় বছরে অন্তত ১০টি ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে এই প্রতারক হাতিয়ে নিয়েছেন ৩০ লক্ষাধিক টাকা।
গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে জাকিরের কাছ থেকে ডলার কিনতে গিয়ে প্রতারিত হন ফ্রিল্যান্সার ইহসান ইফতেখার লাবীব।
ওয়েব ডেভেলপারের কাজ করা লাবীব জানান- সার্ভার, ডোমেইন ইত্যাদির বিল পরিশোধের জন্য পাইওনিয়ার অ্যাকাউন্টে ডলারের প্রয়োজন হয়। টাকার বিনিময়ে তিনি ডলার খুঁজছিলেন। ফেসবুকে ডলার বিক্রির একটি পোস্ট দেখে সেখান থেকে ডলার কিনতে তিনি ম্যাসেঞ্জারে যোগাযোগ করেন। ওই ব্যক্তি লাবীবকে বিকাশে টাকা পাঠাতে বলেন। কিন্তু তিনি চাচ্ছিলেন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে লেনদেন করতে। প্রথম দফায় তিনি আর ডলার কেনেননি।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় মঙ্গলবার জাকির হোসেনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। ছবি: সংগৃহীত
লাবীব জানান, ২০২২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ডলারের জরুরি প্রয়োজন হয়। তখন তিনি আবার ওই ফেসবুক আইডিতে নক করেন। কথা অনুযায়ী, ৩০০ ডলারের জন্য একটি বিকাশ নম্বরে তিনি ৩০ হাজার ৯শ’ টাকা পাঠান। টাকা পাঠানোর পর বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও লাবীব তার পাইওনিয়ার অ্যাকাউন্টে ডলার না পেয়ে ম্যাসেঞ্জারের যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্তু ততক্ষণে লাবীবকে ওই অ্যাকাউন্ট থেকে ব্লক করে দেয়া হয়েছে।
লাবীব এই ঘটনায় মতিঝিল থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন। এই মামলায় মঙ্গলবার রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকা থেকে জাকির হোসেনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগ।
মামলাটির তদারকি কর্মকর্তা অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. সাইফুর রহমান আজাদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জাকির ফ্রিল্যান্সারদের টার্গেট করে প্রতারণা করে আসছিলেন। তিনি ফ্রিল্যান্সারদের আইডিতে থাকা তথ্য ও ছবি নিয়ে ভুয়া নাম ব্যবহার করে ফেসবুক আইডি তৈরি করতেন।
‘ভুয়া এসব আইডি দিয়ে জাকির ফ্রিল্যান্সারদের গ্রুপে জয়েন করতেন এবং অন্যদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতেন। তার ভুয়া আইডিতে ফ্রিল্যান্সারদের মতো তথ্য ও পোস্ট থাকায় অনেকে তার রিকোয়েস্ট গ্রহণ করে নিতেন। এতে করে সত্যিকার ফ্রিল্যান্সারদের গ্রুপে তার আইডির মিউচুয়্যাল ফ্রেন্ডও বেড়ে যেত।
‘এরপর সুযোগ বুঝে এসব আইডি থেকে ডলার বিক্রির পোস্ট দিতেন। এসব পোস্ট দেখে বিশ্বাস করে যারা লেনদেন করতেন তাদেরকেই ব্লক করে নতুন আইডি খুলে প্রতারণা চালিয়ে আসছিলেন এই প্রতারক।’
ডিবি সূত্রে জানা গেছে, জাকিরের অন্তত ১০টি ভুয়া ফেসবুক আইডির সন্ধান পেয়েছে গোয়েন্দারা। সেগুলো হল- অমিত বর্মণ কল্লোল, সিদ্দিকুর রহমান, জুবায়েদ আহম্মেদ আনসারী, চন্দন বিশ্বাস পুলক, খাঁন মুহাম্মদ সাব্বির, কার্তিক দাস, আতিকুর রহমান রাসেল, আব্দুল কাদের, নাবিল হাসান মধু ও জিআর পলাশ। এই আইডিগুলো দিয়ে তিনি প্রতারণা করে আসছিলেন।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ফ্রিল্যান্সারদের ডলার গ্রহণ করার ক্ষেত্রে তেমন কোনো সমস্যা হয় না। তবে ডলার দিয়ে অনলাইনে কোনো কিছুর পেমেন্ট (যেমন ফেসবুক অ্যাডস, ডোমেইন, সার্ভার, ক্লায়েন্ট রিফান্ড ইত্যাদি) করতে গেলে দেখা যায় যে, প্রতি ট্রানজেকশনে বাংলাদেশের ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ ৩০০ ইউএস ডলার পেমেন্ট করা যায়।
এক্ষেত্রে বেশিরভাগ ফ্রিল্যান্সারই এলসি করে ডলার পাঠানোর সুযোগ নেই। কারণ একে তো ডলারের পরিমাণ কম থাকে, অন্যদিকে প্রত্যেকেই সাধারণত অনলাইন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পাইওনিয়ার, পেপাল বা ট্রান্সফারওয়াইজ ব্যবহার করে।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এসব অ্যাকাউন্টে ডলার নেয়ার কোনো উপায় নেই। শুধু অ্যাকাউন্ট টু অ্যাকাউন্ট পেমেন্ট বা সেন্ড মানি করা সম্ভব হয় এবং এটাই একমাত্র উপায়। আর এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়েই অ্যাকাউন্ট টু অ্যাকাউন্ট ট্রান্সফারের ফাঁদ পেতে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন জাকির।
এ ধরনের প্রতারণা এড়াতে ফ্রিল্যান্সারদের সরকারি চ্যানেলে ডলার ট্রানজেকশনের পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. সাইফুর রহমান আজাদ।
তিনি বলেন, ‘সীমাবদ্ধতা থাকলেও ডলার ট্রানজেকশনের ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত বৈধ চ্যানেলগুলোই ব্যবহার করা উচিত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা অন্যান্য মাধ্যমে ডলার কেনাবেচা করলে প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। তাই এসব বিষয়ে ফ্রিল্যান্সারদের আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত।’