বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনভূমি সুন্দরবন বাঘ, চিত্রা হরিণ, কুমিরসহ নানা প্রজাতির মাছ, সরীসৃপ ও পাখির আবাসস্থল। সম্প্রতি এ বনে গাছকাটা প্রায় শূন্যের কোটায় নামলেও থেমে নেই বেশকিছু অনিয়ম।
হরিণের মাংস ও বাঘের চামড়া পাচার চলছে এখনও। নদ ও খালে অসাধু জেলেরা বিষ দিয়ে মাছ শিকার করায় নষ্ট হচ্ছে জলজ পরিবেশ। এ ছাড়া পরিবেশবান্ধব পর্যটন না হওয়ায় বনে বাড়ছে দূষণও।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা থেকে একটি বাঘের চামড়াসহ দুজনকে আটক করে র্যাব। ওই ব্যক্তিরা বনের মধ্যে ছাগলের মাংসের মধ্যে বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহার করে বাঘ শিকার করেছিলেন।
র্যাব-৬-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোসতাক আহমেদ বলেন, ‘এ শিকার তারা প্রায় কোটি টাকা মূল্য বিক্রি করার জন্য শৌখিন মানুষ খুঁজছিলেন গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে তাদের আটক করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘কারা এই পাচার দলের সঙ্গে সংযুক্ত ও কারা এর ক্রেতা, তার কিছু তথ্য আমাদের কাছে আছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা তদন্তাধীন।’
বিভিন্ন হিসেবে, বর্তমানে বিশ্বের ১৩টি দেশে ৩ হাজার ৮৪০টি বাঘ প্রকৃতিতে টিকে আছে। এর মধ্যে ২০১৮ সালের জরিপ অনুয়ায়ী, বাংলাদেশে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা আছে ১১৪টি। তবে ২০০৪ সালের জরিপ অনুসারে সুন্দরবনে বাঘ ছিল ৪৪০টি। অর্থ্যাৎ ১৫ বছরে বন থেকে ৩২৬ টি বাঘ কমে গেছে।
বন বিভাগের হিসাব মতে, ২০০১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনে বাঘ মারা গেছে কমপক্ষে ৪৬টি। এর মধ্যে প্রাকৃতিক কারণে মারা গেছে ৮টি, শিকারিদের হাতে মারা গেছে ১৩টি, লোকালয়ে প্রবেশ করায় স্থানীয়দের হাতে মারা গেছে ৫টি, দুর্বৃ্ত্তদের হাতে মারা যাওয়া বাঘের চামড়া উদ্ধার হয়েছে ১৯টি ও ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরে মারা গেছে একটি। বাকি বাঘগুলি কোথায় গেল তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই।
বন বিভাগের দাবি, সম্প্রতি সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বেশ বেড়েছে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি নতুন করে শুরু হয়েছে বাঘ জরিপ। সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) ও বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, ‘২০২৪ সালের মার্চ মাসে এ জরিপের ফলাফল প্রকাশ করবে বন বিভাগ।’
বাঘের পাশাপাশি সুন্দরবনে থেমে নেই হরিণ শিকারও। বন বিভাগ ও স্থানীর পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৪০ জন শিকারিকে হরিণের মাংস ও চামড়াসহ আটক করা হয়েছে।
বনজীবীরা জানান, হরিণ শিকারের জন্য নাইলনের দড়ির ফাঁদ ব্যবহার করা হয়। সাধারণ গহীন বনে বেশি হরিণ শিকার করা হয়। বাজারে প্রতি কেজি হরিণের মাংসের মূল্য ৮০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত।
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘সুন্দরবনে হরিণ হত্যা ও পাচারের অপরাধে অনেকে আটক হয়েছেন। এই চোরা শিকারিরা অনেক শক্তিশালী। এদের বিরুদ্ধে মানুষ সাক্ষ্য দিতেও ভয় পায়। তারা এই সুযোগ নিয়ে আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসে, আবারও অপরাধে লিপ্ত হয়। তবে ব্যাপকভাবে যে হরিণ শিকার হয়, তা নয়।’
তিনি বলেন, আমাদের পূর্ব ডিভিশনে ৫১৬ জনবলের বিপরীতে কর্মরত আছেন ২৯০ জন। এত কম জনবল নিয়েও আমরা যথেষ্ট অপরাধ নিয়ন্ত্রণ কাজ করছি।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, ‘সম্প্রতি সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী রক্ষায় অপরাধে জড়িতদের তথ্য প্রদানকারীকে পুরস্কার করা হচ্ছে। তথ্য দিলে ৮ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত পুরস্কার দেয়া হচ্ছে। ফলে কেউ হরিণ শিকার করলে আমাদের কাছে তথ্য আসছে, আমরা আটক করতে পারছি।’
২০১৮ সালের জরিপ মতে, এক থেকে দেড় লাখ হরিণ রয়েছে। বাঘ জরিপের আওয়তায় ২০২৪ সালের মার্চ মাসে হরিণের সংখ্যাও জানাবে বন বিভাগ।
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে বলেন, ‘সুন্দরবনে বাঘের ৮০ শতাংশ খাবার আসে হরিণ থেকে। তাই একই প্রকল্পের আওতায় বাঘের শিকার হরিণ ও বন্য শূকর-এ ধরনের প্রাণীর জরিপ করা হচ্ছে।'
সুন্দরবন বনদস্যুদের হাত থেকে বনজীবীরা মুক্তি পেলেও, বনজীবীদের বিষের উৎপাত থেকে মুক্তি পাচ্ছে না সুন্দরবন। জেলেদের ভাষ্য মতে, বনে এখন অল্প সংখ্যক স্থানে অধিক পরিমাণে জেলে একত্রে মাছ শিকার করতে যান। ফলে অনেক সময়ে কোন কোন জেলে বেশি মাছ আহরণ করতে পারেন না। তবে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করলে একসঙ্গে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়।
জেলেরা জানান জানান, একবার কোনো খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করলে ১৫ দিনের মধ্যে ওই খালে কোনো মাছ তো পাওয়ায় যায় না। এমনকি মাছের ডিম বা পোনা পাওয়া যায় না।
বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, কিছু অসাধু জেলে বিষ দিয়ে মাছ শিকারে জড়িত। কিন্তু তারা অল্পদিনে আইনের গণ্ডি পেরিয়ে আবারও বনে গিয়ে অপধার শুরু করে।
বন বিভাগের তথ্যমতে, সুন্দরবনে অভ্যন্তরে বর্তমানে সাতটি পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে। যেগুলে হলো, করমজল, হারবাড়িয়া, কটকা, কচিখালী, দুবলার চর, হিরণ পয়েন্ট ও কলাগাছী। ওইসব স্থানে প্রতি বছর প্রায় ২ থেকে আড়াই লাখ পর্যটক ভ্রমণ করেন। এ ছাড়াও নতুন করে আরও চারটি পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি এন্ড উড ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ড. মো. ওয়াসিউল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনের পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে বনবিভাগ পরিবেশবান্ধব বলে দাবি করলেও, বাস্তবে তা হয়নি। তারা পরিবেশবান্ধব করার চেষ্টা করছে এটা বলা যেতে পারে। আর আমাদের দেশে এটা বাস্তবায়ন হতে আরও অনেক দেরি লাগবে।
তিনি বলেন, ‘বনে পর্যটকরা পলিথিন নিয়ে যাচ্ছেন। খাবারের অংশসহ সেই পলিথিন ফেলে আসছে, এটা বন্যপ্রাণী খাচ্ছে। ফলে তাদের শরীরে এটি ইফেক্ট পড়বে। এখারে বন বিভাগের তদারকির অভাব আছে, কারণ বনে জনবল সংকট। আর আমাদের দেশের মানুষও পরিবেশ সম্পর্ক সচেতন নয়।’