সপ্তাহ বাদে শুরু হতে যাচ্ছে পবিত্র রমজান মাস। এ রমজানে ইফতারের প্রধান অনুষঙ্গ হলো মুড়ি। এক সময় রমজান মাস এলে বাড়ি বাড়ি চলত হাতে ভাজা মুড়ি ভাজার উৎসব। কালক্রমে এখন মাটির চুলায় লাকড়ির আগুনে সেই হাতে ভাজা মুড়ি উৎসব খুব একটা দেখা যায় না। মেশিনের তৈরি মুড়িতেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে রোজাদারদের।
এতসব যান্ত্রিকীকরণের মধ্যেও অর্ধশত বছর ধরে কুমিল্লা বরুড়া উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামের অন্তত ৩০টি পরিবার এবং তাদের সদস্যরা এখনো মাটির চুলায় লাকড়ির আগুনে মুড়ি ভাজেন। বংশ পরম্পরায় দেশীয় ঐতিহ্যটি ধরে রেখেছেন। স্বাদে অনন্য এই মুড়ি কুমিল্লার চাহিদা মিটিয়ে চলে যাচ্ছে চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও ঢাকায়।
সরেজমিনে লক্ষ্মীপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, উঠানের কোণে রান্না ঘরে ব্যস্ত সময় পার করছেন নারীরা। কেউ চুলায় লাকড়ি দিচ্ছেন, কেউবা চুলার উপর মাটির হাড়িতে রাখা চালগুলো নেড়েচেড়ে দিচ্ছেন। কেউবা গরম বালুতে চাল ঢেলে দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফুটন্ত মুড়ি পাত্রে রাখছেন।
বাড়ির পুরুষ সদস্যরা এ মুড়ি চালনির ওপর রেখে ঘোরাতে থাকেন। তখন বালু নিচে পড়ে যায়। আর মুড়ি থাকে চালনিতে। পরিষ্কার মুড়ি তারা বস্তায় ভরেন। রাত ৩টা থেকে শুরু হয় মুড়ি ভাজা, চলে দিনের ১২টা পর্যন্ত।
এভাবে রাত দিন চলে মুড়ি ভাজা ও প্যাকেট করার কাজ। এরপর মুড়ির বস্তা সরবরাহের পালা। বস্তা পাঠিয়ে দেয়া হয় পাইকারদের কাছে।
স্বাধীনতার আগ থেকেই হাতে ভাজা মুড়ি তৈরি হয় বলে লক্ষ্মীপুর গ্রামটি মুড়ির গ্রাম নামেও পরিচিত।
লক্ষ্মীপুর গ্রামের দুর্গাচরণ পাল জানান, তাদের গ্রামে অন্তত ৩০টি পরিবার বাণিজ্যিকভাবে হাতে মুড়ি ভাজার কাজে যুক্ত। প্রতিটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে ২ হাজার ৭০০ কেজি মুড়ি ভাজে। প্রতি কেজি মুড়ি পাইকারের কাছে বিক্রি হয় ১০০ টাকায়। এতে কেজিতে ৮ থেকে ১০ টাকা লাভ হয়। বাজারে হাতে ভাজা এক কেজি মুড়ি বিক্রি হয় ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়।
দুই ধরনের চাল থেকে মুড়ি ভাজা হয়। এর একটি গিগজ চাল। এ চালের মুড়ি লম্বা হয়। তবে বৈশাখ মাসে শুরু হবে টাফি চালের মুড়ি ভাজা। এ চালের মুড়ি গোল হয় এবং বেশ সুস্বাদু।
লক্ষ্মীপুর গ্রামের শ্রীকৃষ্ণ পাল জানান, বছরের অন্য সময় প্রতিমাসে গড়ে অন্তত ৫ লাখ টাকার মুড়ি বিক্রি করেন। তবে রমজানে চাহিদা বেড়ে যায়। এ মাসে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকার মুড়ি বিক্রি করেন।
লক্ষ্মীপুর গ্রামের স্বপন পাল বলেন, তাদের এই ৩০ পরিবার গড়ে প্রতিদিন ৪৫ মন মুড়ি ভাজেন। এই মুড়ি কখনো পাইকারদের সঙ্গে কথা বলে তাদের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেন। আবার কখনো পাইকার গাড়ি নিয়ে তাদের বাড়ির উঠানে অপেক্ষা করেন।
কুমিল্লা নগরীর রাজগঞ্জ বাজারের মুদি দোকানি শাসছুল হক বলেন, ‘নগরীর বেশিরভাগ দোকানে মিলে তৈরি ভাজা মুড়ি বিক্রি হয়। তবে ক্রেতারা সবচেয়ে বেশি চান হাতে ভাজা মুড়ি। ক্রেতাদের কথা চিন্তা করে লক্ষ্মীপুর গ্রাম থেকে হাতে ভাজা মুড়ি আনতে হয়।’
এদিকে লক্ষ্মীপুর গ্রামের উত্তম পাল আক্ষেপ নিয়ে বলেন, ‘আমরা বংশ পরম্পরায় ঐতিহ্যর এই পেশাটি টিকিয়ে রেখেছি। তবে কখনো সরকার থেকে কোন ধরনের সহযোগিতা পাই নাই। বিশেষ করে আমরা জ্বালানির সমস্যায় আছি।’
এ বিষয়ে বরুড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মেহেদী হাসান বলেন, ‘তাদের কী ধরনের সহযোগিতা লাগবে সে বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো আবেদন পাই নাই। যদি তাদের কাছ থেকে সহযোগিতার আবেদন পাই তাহলে বিধি অনুযায়ী তাদের জন্য যা করার সুযোগ থাকবে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা তা করার চেষ্টা করব।’