চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৭ জন। এখনো চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১৮ জন। অবশ্য প্রকৃত হতাহতের সংখ্যা অর্ধশতাধিক বলে দাবি স্থানীয়দের। কারণ আহত অনেকেই চমেক হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে ব্যক্তিগতভাবে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কানে কম শুনছেন কদমরসুল এলাকার অর্ধশতাধিক মানুষ। ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তিন শতাধিক।
এই ঘটনায় মামলা হয় দুইদিন পর। মামলার পর আরও তিনদিন পেরিয়ে গেলেও এখনো ১৬ আসামির কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। পলাতক বললেও প্রকাশ্যেই ঘুরছেন আসামিরা। এমনকি বুধবার জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটির ডাকে হাজিরও হয়েছিলেন আসামিদের অনেকেই। ঘটনার পাঁচদিন পরও অভিযুক্তরা আইনের আওতায় না আসায় বিচার নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
সীতাকুণ্ড মডেল থানার ওসি-তদন্ত আবু সাইদ বলেন, ‘বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত আবদুল কাদিরের স্ত্রী রোকেয়া বেগম ১৬ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন। তবে আসামিরা গা ঢাকা দেয়ায় কাউকে এখনো গ্রেপ্তার করা যায়নি। তারপরও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি আসামিদের আইনের আওতায় আনার জন্য। তাছাড়া মামলার তদন্ত কার্যক্রমও চলছে এখনো।’
বিস্ফোরণের পরদিন সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন ভুক্তভোগীদের কেউ মামলা না করলে পুলিশ দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা করবে। এরপর ৬ মার্চ মধ্যরাতে বিস্ফোরণে নিহত আব্দুল কাদের মিয়ার স্ত্রী রোকেয়া বেগমের দেয়া এজহারে মামলা রেকর্ড করে পুলিশ।
মামলায় কারখানা মালিক তিন ভাই মো. মামুন উদ্দিন, পারভেজ হোসেন সন্টু এবং মো. আশরাফ উদ্দিন বাপ্পি ছাড়াও কারখানার ১৩ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে এজহারনামীয় আসামি করা হয়। মালিকপক্ষের তিন ভাইয়ের মধ্যে মামুন উদ্দিন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাকি দুজন পরিচালক হিসেবে রয়েছেন।
মামলার বাকি আসামিরা হলেন, ম্যানেজার আব্দুল আলীম, অপারেটর ইনচার্জ শামসুজ্জামান শিকদার, অপারেটর খুরশিদ আলম, অপারেটর সেলিম জাহান, নির্বাহী পরিচালক মো. কামাল উদ্দিন, অফিসার সামিউল আোম এবং শান্তনু রায়, সুপারভাইজার ইদ্রীস আলী, সানাউল্লাহ, সিরাজ উদ-দৌলা, রাকিবুল এবং রাজিব। এ ছাড়াও দায়িত্বে অবহেলাকারী সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের অজ্ঞাত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আসামি করা হয়েছে মামলায়।
আড়াই ঘণ্টা আগেই বেরিয়ে যান অপারেটর ইনচার্জ:
সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে অপারেটরদের ইনচার্জ শামসুজ্জামান শিকদার। তবে ঘটনার দিন মেয়ের বিয়ের জন্য বিস্ফোরণের আড়াই ঘণ্টা আগেই কারখানা থেকে বেরিয়ে যান তিনি।
তিনি বলেন, ‘আমি ঘটনাস্থলে না থাকলেও আমাকে আসামি করা হয়েছে। আমি ঘটনাস্থলে ছিলামই না, তাহলে আমার দায়িত্বে অবহেলা হয় কীভাবে? ওইদিন ২টার দিকে আমার মেয়ের বিয়ের জন্য ম্যানেজারকে বলে বেরিয়ে গিয়েছিলাম আমি। অপারেটিংয়ে ছিলেন প্রবেশ লাল শর্মা, (বিস্ফোরণে নিহত) এরপর কীভাবে কী হয়েছে জানিনা।’
তবে সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের একাধিক কর্মকর্তার দাবি অক্সিজেন প্ল্যান্ট অপারেশনে ত্রিশ বছরের বেশি অভিজ্ঞতা শামসুজ্জামানের। তিনিই কলম, কম্প্রেশার, সেপারেশন সবকিছু রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। তারই অধীনে অপারেটররা অপারেটিং করতেন। তিনি উপস্থিত থাকলে দুর্ঘটনা এড়ানো যেত বলে দাবি তাদের।
সীমা অক্সিজেন লিমিটেডের অপারেটর খুরশেদ আলম বলেন, ‘আমরা শামসুজ্জামান শিকদারের অধীনে কাজ করতাম। উনিই আমাদের ইনচার্জ। ঘটনার সময় উনি ছিলেন না, ওনি দুপুরে বেরিয়ে গিয়েছিলেন মেয়ের বিয়ের কথা বলে। উনি থাকলে এই ঘটনা নাও ঘটতে পারত।’
অন্য প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীকেও আসামি করার অভিযোগ:
বিস্ফোরণের ঘটনায় করা মামলার ৭ নম্বর আসামি সেলিম জাহান। মামলার এজহারে তাকে সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের অপারেটর হিসেবে উল্লেখ করা হলেও তিনি মূলত সীমা গ্রুপের আরেকটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ‘অক্সিকো লিমিটিড’ কারখানার অপারেটর।
তিনি বলেন, ‘আমি সীমায় কাজ করতাম না। আমি অক্সিকোর লোক। তবে একই গ্রুপের মালিকের হওয়ায় বিভিন্ন সময় সীমায় যেতাম, কিন্তু বিস্ফোরণের অন্তত তিনদিন আগ পর্যন্ত আমি সীমায় যাইনি।’
বর্তমানে অক্সিকো লিমিটেড বন্ধ থাকলেও তিনি বিভিন্ন যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন বলে জানান।
তবে মামলার বাদি রোকেয়া বেগমের ছেলে রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘অক্সিকো কিছুদিন আগে বন্ধ হয়ে গেছে। অক্সিকোর কর্মীদের সীমায় নিয়ে আসা হয়েছিল। তাই সেও অক্সিকোতে ছিল, এজন্য তাকে আসামি করা হয়েছে।’
কর্মী ছাঁটাইয়ের কারণে দুর্ঘটনার আশঙ্কায় ছিলেন নিহত কাদের:
অর্থাভাবে দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মীদের কারখানা থেকে ছাঁটাই করায় আব্দুল কাদের আগেই দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছিলেন বলে এজহারে উল্লেখ করেছেন তার স্ত্রী রোকেয়া বেগম। এজহারে তিনি লিখেন, ‘১০ থেকে ১৫ দিন পূর্বে কথা বলার সময় বলেছিল যে কারখানা থেকে অর্থের অভাবে মালিকপক্ষ অনেক অভিজ্ঞ ও দক্ষ শ্রমিক-কর্মচারীকে ছাঁটাই করেছে। বর্তমানে যারা কাজ করছে তারা প্রায়ই অনভিজ্ঞ এবং অদক্ষ। আল্লাহই জানেন কখন যে কি দুর্ঘটনা ঘটে যায়। একথা শুনে আমরা খুব চিন্তিত ছিলাম। এর কয়েকদিন না যেতেই ৪ মার্চ বিকেল সাড়ে চারটার দিকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।’
প্ল্যান্টে দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের ইচ্ছাকৃত অবহেলার কারণে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
এজাহারে আরও বলা হয়, ‘ঘটনার পর তার স্বামীর কর্মস্থলের কেউ তাদের নূন্যতম খোঁজখবর নেননি, কোনো সহায়তাও করেননি।’
তার অভিযোগ, যথাযথ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বিপজ্জনকভাবে গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ, নিয়মিত পরীক্ষাপূর্বক রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা না রাখা এবং তাৎক্ষণিকভাবে দুর্ঘটনা মোকাবিলা করার মতো প্রশিক্ষিত জনবল না থাকায় ওই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।
নিহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে মালিকপক্ষ:
শুক্রবার বিকেলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মাসুদ কামাল জানান, শুরুতে নিহতদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে দুই লাখ টাকা নির্ধারণ করেছিল মালিক পক্ষ। পরে মালিকপক্ষ ও সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহাদাত হোসেন জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে আসেন।
সেখানে তাদের জানানো হয়েছে অন্তত বিএম কন্টেইনার ডিপুর মত নিহতদের যেন ১০ লাখ টাকা করে দেয়া হয়। যাদের অঙ্গহানি হয়েছে তাদের ৫ লাখ ও যারা সাধারণ আহত হয়েছে তাদের ২ লাখ টাকা করে দিতে হবে। মালিকপক্ষ এতে সম্মত হয়ে বৃহস্পতিবার বিকেলেই নতুন নির্ধারিত অংকের চেক সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করে মালিকপক্ষ।
তিনি বলেন, ‘এখানে একটা বিষয় হচ্ছে নিহতদের ১০ লাখ টাকাটা তারা দুই ভাগে দিচ্ছে। কারণ নিহত শ্রমিকদের শ্রম আউন অনুযায়ী ২ লাখ টাকা দিতে হবে। তাই শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ওই দুই লাখ টাকা করে দিয়ে আমাদের ৮ লাখ টাকা করে চেক দিয়েছেন। তাছাড়া বাকীদের চেকও হস্তান্তর করা হয়েছে। চেকগুলো ইতোমধ্যে অনেকেই সংগ্রহ করেছেন, যারা করেননি সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছ থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন, ওনার কাছে জমা আছে।’
এর আগে বুধবার নিহতদের ২ লাখ টাকা করে দেয়ার কথা জানিয়ে গণমাধ্যমে একটি সংবাদ বিজ্ঞাপ্তি পাঠায় সীমা অক্সিজেন লিমিটেডের ব্যবস্থাপক ইফতেখার উদ্দিন।