বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

৫২ বছর পর শহীদ স্বজনদের স্মৃতিচিহ্ন পেলেন তারা

  •    
  • ৬ মার্চ, ২০২৩ ১৩:২৮

ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা কেবল বলি ৩০ লাখ শহীদ, কিন্তু তাদের পূর্ণাঙ্গ কোনো তালিকা নেই। কাকে কোথায় হত্যা করা হয়েছে, কোথায় কবর দেয়া হয়েছে কেউ জানে না। আমরা এসব খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। সেই লক্ষ্যে ২০১৭ সালে সালুকর বধ্যভূমিকে উদ্যান করার উদ্যোগ নেই।’

একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী গকুলানন্দ চক্রবর্তীকে যখন হত্যা করে মেয়ে রীনা চক্রবর্তী তখন মায়ের গর্ভে। বাবার মৃত্যুর কয়েক মাস পর জন্ম হয় তার। এতদিন কেবল গল্প শুনেছেন, বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন, তবে কোথাও বাবার কোনো স্মৃতিচিহ্ন ছিল না।

অবশেষে ৫২ বছর পর শনিবার বাবার স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে পেলেন রীনা। কখনো না দেখে বাবার স্পর্শ পেলেন যেন।

সিলেটের সালুটিকর বধ্যভূমিতে শহীদ গকুলানন্দ চক্রবর্তীর স্মৃতিফলকে হাত বুলাতে বুলাতে কান্নাজড়িত কণ্ঠে রীনা চক্রবর্তী বলেন, ‘বাবাকে আমি কখনো দেখিনি। কোথাও তার স্মৃতিচিহ্নও ছিল না। ৫২ বছর পর আজকে এই বধ্যভূমিতে তার একটি স্মৃতিফলক লাগানো হলো। এই প্রথম যেন আমি বাবার স্পর্শ পেলাম।’

রীনা চক্রবর্তীর মতো ৬৩টি পরিবার প্রথমবারের মতো দেশের জন্য আত্মত্যাগকারী তাদের শহীদ স্বজনদের স্মৃতিচিহ্নের সন্ধান পান এই বধ্যভূমিতে।

একাত্তরে সালুটিকর এলাকার সিলেট ক্যাডটে কলেজে ক্যাম্প গড়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। মুক্তিযোদ্ধাসহ বাঙালিদের ধরে এনে হত্যা ও নির্যাতন করা হতো এখানে। হত্যার পর ক্যাডেটে কলেজের পেছনেই গণকবর দেয়া হয় তাদের। এখানে অন্তত দুশজন বাঙালিকে গণকবর দেয়া হয় বলে ধারণা করা হয়।

সালুটিকরের এই গণকবরটি সবার কাছেই বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত থাকলেও এতদিন এটি পড়েছিল পরিত্যক্ত অবস্থায়। ঘন জঙ্গলে পূর্ণ ছিল এই টিলাভূমি, ছিল না কোন স্মৃতিচিহ্নও। সেনানিবাসের সংরক্ষিত এলাকায় এই বধ্যভূমির অবস্থান হওয়ায় সাধারণের প্রবেশাধিকারও ছিল না।

অবশেষে স্বাধীনতার ৫২ বছর পর দুই মুক্তিযোদ্ধার উদ্যোগে এই বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়। তাদের উদ্যোগেই এখানে নির্মাণ করা হয়েছে নান্দনিক শহীদ স্মৃতি উদ্যান। শনিবার এই উদ্যানের উদ্বোধন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ স্বজনরা।

বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ আব্দুস সালাম বীর প্রতীক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদের উদ্যোগে নির্মিত এই শহীদ স্মৃতি উদ্যানে এ পর্যন্ত এখানে গণকবর দেয়া ৬৩ জন শহীদকে চিহ্নিত করে তাদের নামে আলাদা স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। গণকবর দেয়া বাবী শহিদদেরও চিহ্নিত করে তাদেরও স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হবে বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা।

৫২ বছর ধরে বাবার কবর খুঁজছেন শাহরীন রহমান লুবনা। তার বাবা শহীদ কর্নেল ডা. আবু ফজল জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে সময় সিলেট মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। ৭১ এ বাবাকে সিলেটে হত্যা করে পাকবাহিনী এইটুকুই কেবল জানতেন শেহরিন। কিন্তু কোথায় কীভাবে হত্যা করা হয় তার কোনো তথ্যই জানতেন না।

শাহরীন বলেন, ‘৫২ বছর ধরে আমি বাবার স্মৃতিচিহ্ন খুঁজছি। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি। কিন্তু কোথাও পাইনি। অবশেষে আজকে বাবার স্মৃতি খুঁজে পেলাম।’

এমন উদ্যোগ যারা নিয়েছেন তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তারা একটি অসাধ্য সাধন করেছেন। যেন আমার বাবাকেই আমার কাছ ফিরিয়ে দিয়েছেন। দুপুরে শহীদ স্মৃতি উদ্যানের উদ্বোধন করেন শহিদ সিরাজুল আবদালের স্ত্রী সৈয়দা সকিনা আবদাল।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্ঠা রাশেদা কে চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধা কাউন্সিলের সাবেক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব) হেলাল মোর্শেদ খানসহ শহীদের স্বজনরা।

উদ্বোধনকালে কান্না ছাড়া কোন কথা বলতে পারেননি শহীদ সিরাজুল আবদালের স্ত্রী সৈয়দা সকিনা আবদাল।

ছেলে মেজর ডা. (অব) সৈয়দ জামিল আব্দাল বলেন, ‘একাত্তরে বাবা এখানকার চা বাগানে চাকরি করতেন। চাকরি ছেড়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন, তাকে পাকিস্তানি আর্মিরা ধরে এখানে এনেছিল বলে জেনেছিলাম, কিন্তু পরে আর কোনো খোঁজ পাইনি। আজকে এতোদিন পর তার স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে পেলাম। এই প্রথম মনে হচ্ছে আমার বাবাকে স্বীকৃতি দেয়া হলো।’

শহীদ স্মৃতি উদ্যান ঘুরে দেখা যায়, বিশাল চত্বরে নির্মাণ করা হয়েছে দুটি স্মৃতি স্তম্ভ। একটি স্তম্ভে রয়েছে এখানে শায়িত সব শহীদদের নাম। এ ছাড়া সব শহীদদের জন্য কবরের আদলে আলাদা আলাদা স্মৃতিফলকও রয়েছে। ফুল আর গাছে গাছে আচ্ছাদিত পুরো চত্বরের বিভিন্ন স্থানে এই উদ্যান নির্মাণের পটভূমি, এখানে শায়িত সব শহীদদের জীবনী লেখা রয়েছে। এই স্মৃতি উদ্যানে পাঠাঘার, যাদুঘর, কফিশপ এবং আলাদা বসার জায়গা নির্মাণ করা হবে বলে জানান উদ্যোক্তারা।

উদ্যোক্তাদের অন্যতম বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদ।

এ উদ্যোগ প্রসঙ্গে ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা কেবল বলি ৩০ লাখ শহীদ, কিন্তু তাদের পূর্ণাঙ্গ কোনো তালিকা নেই। কাকে কোথায় হত্যা করা হয়েছে, কোথায় কবর দেয়া হয়েছে কেউ জানে না। আমরা এসব খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। সেই লক্ষ্যে ২০১৭ সালে সালুকর বধ্যভূমিকে উদ্যান করার উদ্যোগ নেই।’

তিনি বলেন, ‘এটা কেবল কবরস্থান নয়, আমাদের ইতিহাসেরও অংশ। তাই এটিকে সেভাবেই নির্মাণের চেষ্টা করেছি। এখানে এসে মানুষজন কেবল কষ্ট পাবে না, জানতে পারবে এবং আনন্দ পাবে।’

একাত্তরে ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদের সাথেই ৩ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেন কর্নেল (অব) মোহাম্মদ আব্দুস সালাম বীর প্রতিক। এ দুজন মিলেই নিজেরা চাঁদা তুলে গড়ে তুলেন এই স্মৃতি উদ্যান।

মোহাম্মদ আব্দুস সালাম বলেন, ‘এটি আগে পরিত্যক্ত ছিল। জঙ্গল হয়ে গিয়েছিল, কেউ চিনত না। আমরা সেনাবাহিনীর অনুমতি নিয়ে এখানে উদ্যান নির্মাণের উদ্যোগ নেই। গবেষণার মাধ্যমে এখানে শহীদ হওয়া ব্যক্তির নাম ঠিকানা খুঁজে বের করি। ভবিষ্যতে এটি রক্ষনাবেক্ষণের দায়িত্ব সেনাবাহিনীর কাছেই হস্তান্তরের ইচ্ছে আমাদের।’

তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারগুলোকে নিয়ে কেউ কিছু ভাবছেন না। তাদের নিয়ে তেমন কোনো কাজ হয়নি। বাংলাদেশে যে একাত্তরে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, তা বহির্বিশ্বের মানুষ জানেনই না। গণহত্যার বিষয়টি আমাদের আরও ব্যাপক প্রচার করতে হবে।’

এ বিভাগের আরো খবর