ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খানের বিচার চেয়ে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে বিক্ষোভ করেছেন ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনটির অভিযোগ, অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান তাদের এক নেতাকে ক্লাসে অপমান করেছেন। সে অপমান সহ্য করতে না পেরে তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন।
ছাত্রলীগের ওই নেতার নাম এসএম এহসান উল্লাহ ওরফে ধ্রুব, যিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ছাত্রলীগের প্রশিক্ষণবিষয়ক উপসম্পাদক।
সংগঠনটির ভাষ্য, ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ধ্রুব। পরে তাকে শহীদুল্লাহ হলের পুকুরপাড় থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
ফেসবুক স্ট্যাটাস
এ বিষয়ে ধ্রুব ‘এন্ড অফ দ্য জার্নি’ শিরোনামে ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সালাম জানবেন। আমার খুব ইচ্ছা ছিল আপনার সাথে দেখা করার; আপনার একটা ছবি তোলার। পূরণ হলো না। জীবনের সব ইচ্ছা পূরণ হয় না। কী আর করা, কিন্তু আপনার কাছে আমি আমার সাথে হওয়া অন্যায়ের বিচার দিয়ে গেলাম!’
পোস্টে তিনি আরও লেখেন, ‘প্রিয় তানজিম স্যার, আপনার পরে আমার আর কোনো রাগ নেই। ভালো থাকবেন। বাবা মা, ক্ষমা করে দিও।
‘ভেবেছিলাম দোকান ঘুরে ঘুরে দুই-একটা করে কিনব। এক দোকানেই দুই পাতা বিক্রি করল। সন্দেহ হচ্ছে ঔষধে ভেজাল আছে। যদি ভেজাল না থেকে থাকে তাহলে এন্ড অফ দ্য জার্নি (যাত্রা বা জীবনের সমাপ্তি)।’
এই পোস্টের নিচে ধ্রুব অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খানকে মেইল করার একটি স্ক্রিনশটও সংযুক্ত করেন। সেই মেইলের সাবজেক্ট দেয়া হয়েছে ‘থ্যাংকস ফর কিলিং মি স্যার।’
মেইলে ধ্রুব লিখেন, ‘আই ডিড’ন্ট ডিজার্ভ দ্যাট। আই ওয়েন্ট টু ইউ অ্যাজ মাই টিচার কজ আই ওয়াজ’ন্ট গিল্টি। ইফ ইউ ওয়ান্টেড টু প্রিভেন্ট দ্য রিউমার, ইউ কুড ডু ইট জাস্ট বাই ওয়ার্নিং এভরিওয়ান, বাট ইউ চুজ টু হিউমিলিয়েটেড মি (আমি এটা আশা করিনি। শিক্ষক বলে আপনার কাছে গিয়েছিলাম, কারণ আমি দোষী ছিলাম না। গুজব ঠেকাতে চাইলে আপনি সবাইকে সতর্ক করে সেটা করতে পারতেন, কিন্তু আপনি আমাকে অপমান করার সিদ্ধান্ত নিলেন)।
‘আপনি আপনি যতই অস্বীকার করেন, আমি ছাত্রলীগ করি বলে আপনি এমন করেছেন। ডিইউ ক্যাম্পাস নোজ মি মোর অ্যাজ আ ফটোগ্রাফার দ্যান এ বিএসএল অ্যাকটিভিস্ট (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ কর্মীর চেয়ে ফটোগ্রাফার হিসেবেই আমার বেশি পরিচিতি)। আমি রাজনীতিতে সক্রিয়ও না দীর্ঘদিন ধরে। আমার সাথেই অন্যায় করা হয়েছে, আপনিও আমার সাথে অন্যায় করলেন। থ্যাংকস ফর কিলিং মি (আমাকে হত্যার জন্য ধন্যবাদ)।’
কী বলছেন অধ্যাপক তানজীম
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান শুক্রবার নিউজবাংলাকে বলেন, “গত সোমবার এহসান আমার রুমে আসে। রুমে এসে সে নিজের পরিচয় দিয়ে গত বছর হওয়া একটি ট্যুর নিয়ে একটা মেয়েকে ঘিরে খুব অশ্লীল কথা বলে। এরপর আমি তাকে বলি, তুমি কার সামনে এসব কথা বলছ? আমি তোমার শিক্ষক। আর আমিই তো তাদের ট্যুরে নিয়ে গেছি। আর আমি কি এতটাই দায়িত্বজ্ঞানহীন যে, আমার উপস্থিতিতে আমার শিক্ষার্থীরা এসব কাজ করবে?
“এরপর সে বলে, ‘স্যার এটা সত্য। এটা অনেকেই বলাবলি করছে।’ তারপর আমি বলি, যারা বলছে, তুমি আমাকে নামগুলো বলো। ডিপার্টমেন্ট নিয়ে এত বাজে কথা; এগুলো বন্ধ হওয়া জরুরি। এর মধ্যে সে ওই মেয়েটাকে নিয়ে অনেক কথা বলার চেষ্টা করছে। আমি তাকে বলি, এটা তোমাদের পারসোনাল সমস্যা। আমি এটা নিয়ে আলাপ করতে চাই না।”
তিনি বলেন, ‘পরে শুনেছি এই ছেলের সাথে সেই মেয়ের বন্ধুত্ব ছিল। একপর্যায়ে এই ছেলে সেই মেয়েকে প্রপোজ করে, কিন্তু মেয়েটি রাজি হয়নি। ধ্রুবর ভাষ্য, রিজেক্ট করার পর থেকে সেই মেয়ে এবং তার বন্ধুরা তাকে অপদস্ত করে বেড়ায়।’
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এ অধ্যাপক বলেন, ‘সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার এক শিক্ষকের অনুরোধে আমি তাদের একটা ক্লাস নিতে যাই। যদিও তাদের কোনো কোর্স আমি পড়াই না। তখন ক্লাস শেষে আমি তাকে দাঁড় করাই। তাকে বলি, তুমি যে সুন্দরবন ট্রিপ নিয়ে এত আজেবাজে কথা বলছো আর সেটি আমার রুমে গিয়ে আমাকেও বলেছো, এটা কি ঠিক? তোমার আশেপাশে থাকা সবাই তো তোমার বন্ধু। তাদের সম্পর্কে কি এত আজেবাজে কথা বলা যায়?
‘এরপর আমি তাকে বলি, এই রিউমারটা থামানো জরুরি। কারণ এটি আমার এবং ডিপার্টমেন্টের জন্য খারাপ। তুমি যদি অনেস্ট হও তাহলে যারা এটি তোমাকে বলেছে তাদের নামগুলো বলো। কারণ এটি আর বেশিদূর আগানো উচিত না। এরপর সে নাম বলতে না চাইলে আমি তাকে বলি, ওকে। এবার মুখটা স্টপ করে বসো। আমি আর এই বিষয়ে কথা বলতে চাই না।’
তানজীমউদ্দিন বলেন, “এরপর সে বসা থেকে আবার উঠে দাঁড়ায়। সে বলে, ‘স্যার আমি কিন্তু ঠিক আছি।’ তখন আমি বলি, আমি এটা নিয়ে আর কোনো কথাই বলতে চাই না। এরপর আমাদের ক্লাস শেষ হয়ে যায়। তখন সে আবার আমার সামনে আসে। আমি তাকে বলি, তুমি আমার থেকে দূরে থাকো। আমি কথা বলতে চাই না।
“এরপর আমি আরও কিছুদূর আগানোর পর সে আবার আসে। বলে, ‘স্যার আপনি আমাকে হিউমিলিয়েট (অপমান) করেছেন। মেয়েটা এবং তার বন্ধুরাও আমাকে হিউমিলিয়েট করে।’ আমি তাকে বলি, তাদের হিউমিলিয়েশনের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নাই। আমি তোমার কাছে শুধু জানতে চেয়েছি, কারা এগুলো ছড়াচ্ছে। এর বেশি কিছু তো আমি তোমার কাছ থেকে জানতে চাইনি। এরপর আমি যখন লিফটের সামনে যাই, তখন সে কান্নাকাটি করে আমাকে বলে, ‘আমি আত্মহত্যা করলে আপনি দায়ী থাকবেন।’ এসব বলে সে চলে যায়।”
পরের অবস্থা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এ শিক্ষক বলেন, “পরে আমি নিচে নেমে তার দুজন সহপাঠীর সাথে কথা বলছিলাম। তখন ধ্রুব আমাদের ক্রস করে চলে যাচ্ছিল। তখন আমি তাদের দুজনকে বললাম যে, ধ্রুবকে একটু ডাকো; আমি একটু কথা বলি। সে আসলে আমি তাকে বলি, তুমি কি কোনো মানসিক চাপে আছো? আমি তাকে বলি, তুমি কি দুপুরবেলা বা সকালে খেয়েছ? সে বলে, ‘না স্যার।’ তখন আমি তাকেসহ আরও কয়েকজনকে নিয়ে খেতে যাই।
“এরপর ফুচকা খাই। এ সময় আমি তাকে বোঝালাম যে, একটা মেয়ের ঘটনা নিয়ে কেন তুমি পিছনে পড়ে থাকছো? তোমার কাজ তো পড়ালেখা করা। মন দিয়ে পড়াশোনাটা করো। তখন সে আবারও বলল যে, আমি তাকে হিউমিলিয়েট করেছি। আমি বলি, তুমি মানসিক চাপে আছো। তোমার বাবার নম্বরটা আমাকে দাও। আমি কথা বলি।
“এরপর সে আবার বলে, ‘স্যার আপনি আমাকে হিউমিলিয়েট করেছেন, কারণ আমি ছাত্রলীগ করি।’ তার কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়ি। বলি ছাত্রলীগের সাথে এটার কী সম্পর্ক? এটাকে এভাবে দেখো না। সে বলে, ‘না, ছাত্রলীগ করি বলেই আপনি আমাকে অপমান করেছেন।’ এরপর তাকে আরও বুঝিয়ে আমি বাসায় চলে যাই।
“এরপর রাতে যখন আমি শিক্ষক ক্লাবে যাই, তখন একজন ছাত্রের মাধ্যমে আমি পোস্টের বিষয়টা জানতে পারি। এরপর তার বাবাকে ফোন দিই। তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তার মা ফোন ধরে। উনার সাথে আমি কিছুক্ষণ কথা বলি। এরপর আমি তার হলে তার কয়েকজন বন্ধুকে পাঠাই। তারা তাকে খুঁজে পায়নি। পরে আমি তাকে কল দিই। সে ফোন কেটে দেয়। এরপর আমার সাবেক এক শিক্ষার্থীকে আমি তার নাম্বারটা দিয়ে তাকে লোকেট করতে বলি। পরে তার অবস্থান জানা যায়।”