চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে (চমেক) শিবির সন্দেহে চার শিক্ষার্থীকে মারধরের পর নিরাপত্তাহীনতায় অন্তত ২০ শিক্ষার্থী হোস্টেল ছেড়ে গেছেন। আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের বাসায় থেকে ক্লাস করলেও নিরাপত্তাহীনতার কারণে হোস্টেলে ফিরতে পারছেন না তারা। আবার কেউ কেউ দিনে হোস্টেলে অবস্থান করলেও ‘মারধর’ আতঙ্কে রাত কাটাচ্ছেন হোস্টেলের বাইরে।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত নেতারা চার শিক্ষার্থীকে মারধরের পর তাদেরও টার্গেট করেছেন। মারধরের ওই ঘটনার দুই সপ্তাহ পরও অভিযুক্তদের বিচার না হওয়ায় তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। হামলা-মারধরের ভয়ে হোস্টেলে ফিরতে পারছেন না তারা।
চমেকের ৬২হম ব্যাচের এক শিক্ষার্থী মঙ্গলবার নিউজবাংলাকে এসব তথ্য জানান।
তিনি বলেন, ‘৮ ফেব্রুয়ারি রাতে চারজনকে মারধরের পর আমাদেরও টার্গেট করেছে বলে পলিটিক্যাল (রাজনীতিতে জড়িত) বন্ধুদের মাধ্যমে খবর পেয়েছি আমরা। পরদিন সকালেই ৬২তম ব্যাচের তিনজন আঁচ পেয়ে হোস্টেল ছেড়ে পালিয়ে যায়। এর কয়েকদিনের মধ্যেই বিভিন্ন ব্যাচের অন্তত ২০ জন হোস্টেল ছেড়ে গেছে।
‘চার ছাত্রকে মারধরে জড়িতদের ভয়ে তারা হোস্টেলে ফিরতে পারছে না। তবে তাদের অনেকেই আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের বাসায় থেকে গোপনে ক্লাসে অংশগ্রহণ করছে।
ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘ভুক্তভোগীদের মধ্যে আমিও একজন। কোনো কারণ ছাড়াই তারা আমাদের টার্গেট করেছে। হামলার ভয়ে আমরা ৯ তারিখ হোস্টেল ছেড়েছি। এখনও হোস্টেলে ফিরতে পারিনি। আমাদের ভয়, অভিযুক্তদের কেউ কিছু বলছে না। এই যে চারজনকে কোনো কারণ ছাড়াই মেরে আধমরা করলো, কেউ টুঁ শব্দও করেনি। একটা কমিটি হয়েছে। শুনেছি তদন্ত হচ্ছে। তবে কমিটিকে সাতদিন সময় দেয়া হলেও ১৪ দিন পার হয়ে গেছে। আর কোনো খবর নেই।’
তবে শিক্ষার্থীদের হোস্টেল ছেড়ে যাওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে বক্তব্য জানতে চমেক ছাত্রাবাসের ইনচার্জ ডা. মিজানুর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।
এদিকে শিক্ষার্থীদের মারধরের ঘটনা তদন্তে ১৪ ফেব্রুয়ারি একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় উপাধ্যক্ষ মো. হাফিজুল ইসলামকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তী কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। পরে আরও ৭ কর্মদিবস সময় বৃদ্ধি করে কমিটি। মূলত ৯ সদস্যের অভিযোগ নিষ্পত্তি কমিটিই ঘটনার তদন্ত করছে।
তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে উপাধ্যক্ষ মো. হাফিজুল ইসলাম বলেন, ‘নানা কাজে ব্যস্ত থাকায় নির্দিষ্ট সময়ে তদন্ত কাজ শেষ করা যায়নি। আমরা আরও ৭ কার্যদিবস সময় চেয়ে নিয়েছি। সে হিসাবে আগামী রবি-সোমবার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া যাবে বলে আশা করছি।’
ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটির কাছে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন মারধরের শিকার শিক্ষার্থীরা। তবে একাডেমিক কাউন্সিল সভার প্রায় দুই সপ্তাহ পরও তদন্ত কমিটি অভিযুক্তদের সঙ্গে কথা বলেনি বা বলতে পারেনি বলে অভিযোগ চমেক শিক্ষার্থীদের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপাধ্যক্ষ হাফিজুল ইসলাম বলেন, ‘তদন্তাধীন বিষয়ে বিস্তারিত জানানো আইনের লঙ্ঘন।’
এর আগে ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে ৬২তম ব্যাচের চার শিক্ষার্থীকে হল থেকে ডেকে নিয়ে পৃথক কক্ষে মারধর করেন কলেজ থেকে বহিষ্কৃত কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা। পরদিন দুপুরে পুলিশের সহযোগিতায় দুই শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করে চমেক হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। বাকি দু’জনকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয় মারধরকারীরা।
মারধরের শিকার চারজন হলেন- ৬২তম ব্যাচের এম এ রায়হান, মোবাশ্বির হোসেন শুভ্র, জাহিদ হোসাইন ওয়াকিল ও সাকিব হোসেন।
তাদের মধ্যে জাহিদ হোসাইন ওয়াকিল ও সাকিব হোসেনকে শুরুতে চমেক হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। পরবর্তীতে অবস্থার উন্নতি হলে ১৯ ফেব্রুয়ারি তাদেরকে বাড়িতে নিয়ে যান অভিভাবকরা।
মারধরের ঘটনায় অভিযুক্তরা হলেন- ২০২১ সালে ছাত্রলীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় সাড়ে তিন বছরের জন্য বহিষ্কৃত ৬০তম ব্যাচের অভিজিৎ দাশ, দুই বছরের জন্য বহিষ্কৃত ৫৯তম ব্যাচের রিয়াজুল ইসলাম জয়, এক বছরের জন্য বহিষ্কৃত জাকির হোসাইন সায়েম ও মাহিন আহমেদ। তাদের মধ্যে অভিজিৎ ও জয়ের বহিষ্কারাদেশ এখনও বহাল রয়েছে।
এছাড়াও হামলার আভাস পেয়ে ৯ ফেব্রুয়ারি হোস্টেল ছেড়ে পালিয়ে যায় আরও তিন শিক্ষার্থী। তাদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মূলত আমাদের ৬২তম ব্যাচের কয়েকজনের সঙ্গে ব্যক্তিগত শত্রুতার জের ধরে আমাদের নামের পাশে ওরা শিবির ট্যাগ লাগিয়ে দিয়েছে। আর শিবির ট্যাগ লাগিয়েই ব্যাচের চারজনকে বুধবার রাত ১টার দিকে ডেকে নিয়ে ওরা মারধর করে। তাদের মধ্যে একজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় চমেক হাসপাতালে না নিয়ে গোপনে আন্দরকিল্লায় জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায় তারা। পরে তাকে আবার রুমে নিয়ে আসে।’