ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ কর্মকর্তা বা ব্যাংকার পরিচয়ে তরুণীর সঙ্গে প্রেম। এরপর ঘনিষ্ঠতা থেকে ব্যক্তিগত সময় কাটানো। গোপনে সেই ব্যক্তিগত মুহূর্তের ভিডিও ধারণ করে পরবর্তীতে তা দিয়ে করা হতো ব্ল্যাকমেইল। আদায় করা হতো মোটা অঙ্কের টাকা। কেউ টাকা না দিলে তার আপত্তিকর ভিডিও ক্লিপ ছেড়ে দেয়া হতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
অভিযুক্ত ওই ভুয়া ম্যাজিস্ট্রেটের নাম মেহেদী হাসান। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পড়ুয়া শতাধিক তরুণীর সঙ্গে ভুয়া পরিচয়ে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে এভাবে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজসহ নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ধনাঢ্য তরুণীদের টার্গেট করতেন মেহেদি হাসান।
তাদের কাছে নিজেকে কখনও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, কখনও সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি), আবার কখনও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিতেন। যোগাযোগ শুরুর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতেন সামাজিক যোগাযোগ। এরপর জড়াতেন প্রেমের সম্পর্কে। তরুণীদের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন সময় একান্তে সময় কাটানোর দৃশ্য নিজের মোবাইল ফোনে গোপনে ধারণ করতেন। এরপর তরুণীদের ব্ল্যাকমেইল করে তাদের পরিবার থেকে লাখ লাখ টাকা আদায় করতেন।
মেহেদী হাসান ২০১৭ সাল থেকে এভাবে প্রতারণা করে আসছেন। ২০২০ সালে শিমু (ছদ্মনাম) নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়েন। শিমুর কাছে মেহেদী নিজেকে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে পরিচয় দেন। সম্পর্ক থাকাকালে মেহেদী কৌশলে শিমুর নগ্ন ভিডিও ও ছবি নিতেন।
পরবর্তীতে শিমু জানতে পারেন, মেহেদী কোনো চাকরি করেন না। তিনি একজন প্রতারক। নিজেকে সরকারি কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে তিনি প্রথমে মেয়েদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়েন। পরে তাদের অশ্লীল ছবি ধারণ করে ব্লাকমেইল করেন। এসব জানার পর মেহেদীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন তিনি।
সম্পর্ক ছিন্ন করলেও ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে বিভিন্ন সময় মেহেদী ওই তরুণীর ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা দাবি করেন। শিমুর কাছ থেকে এভাবে আড়াই লাখ টাকা আদায় করেন মেহেদী।
মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মেহেদী কয়েক দফায় এই টাকা নেন। লোকলজ্জার ভয়ে শিমু বিষয়টি কারও কাছে প্রকাশ করেননি। তবে মেহেদী থেমে যাননি। তিনি আরও টাকা দাবি করেন। শিমু আর কোনো টাকা দেবেন না জানিয়ে দিলে মেহেদী শিমুর আত্মীয়দের মোবাইল নম্বর ও ফেসবুক আইডি সংগ্রহ করে তার অশ্লীল ছবি ও ভিডিও মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দেন।
গত দুই বছর ধরে শিমুর বিভিন্ন আত্মীয়কে মেহেদী এসব ভিডিও ক্লিপ পাঠিয়েছেন। উপায় না দেখে শিমুর বাবা ১৫ ফেব্রুয়ারি পল্টন মডেল থানায় পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা করেন।
মামলায় তিনি অভিযোগ করেন, তার মেয়ের মামার ফেসবুক মেসেঞ্জারে মেয়ের অশ্লীল ভিডিও পাঠিয়ে টাকা দাবি করে মেহেদী। টাকা না দিলে এই ভিডিও আরও ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়।
মামলাটির তদন্ত শুরু করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগের সোশ্যাল মিডিয়া ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম। বৃহস্পতিবার সাভার থেকে মেহেদী হাসানকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। পুলিশের কাছে মেহেদী স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। এছাড়া অন্য অনেকের অশ্লীল ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়াসহ বিভিন্ন অপরাধের কথা স্বীকার করেছেন তিনি।
মেহেদীর ব্যবহৃত মোবাইল ফোন পর্যালোচনা ও ফরেনসিক পরীক্ষা করেছে ডিবি। উদ্ধার করা হয়েছে ধনাঢ্য পরিবারের মেডিক্যাল, বুয়েট ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শতাধিক শিক্ষার্থীর নগ্ন ছবি ও ভিডিও। আপত্তিকর ভাষায় চ্যাটিং হিস্ট্রিও পাওয়া গেছে তার মোবাইলে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, মেহেদি নিজেকে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে ধনাঢ্য পরিবারের মেডিক্যাল, বুয়েটসহ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণী ও নারীদের টার্গেট করে ফেসবুকে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলতেন। প্রেমের সম্পর্কের একপর্যায়ে নারীদের বিয়ের প্রলোভন দিয়ে একান্তে সময় কাটানো এবং কৌশলে তাদের নগ্ন ভিডিও ও ছবি সংগ্রহ করতেন।
জিজ্ঞাসাবাদে মেহেদী জানিয়েছেন, সাত বছর ধরে তিনি শতাধিক নারীর সঙ্গে এ ধরনের অপকর্ম করেছেন। তবে কেউ সাহস করে মামলা করেননি। সবাই টাকা দিয়ে ম্যানেজ করেছেন তাকে।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার তারেক বিন রশীদ বলেন, ‘আমরা ভুক্তভোগীর অভিযোগের সত্যতা পেয়েছি। আবার আসামিকে গ্রেপ্তার করার পর তার ডিভাইসগুলোতেও অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেছে।’