বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘বাঘের বাড়ি’তে পর্যটনকেন্দ্র

  •    
  • ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ২২:১৩

বনরক্ষীরা জানিয়েছেন, গত দুই বছর ধরে সেখানে কর্মযজ্ঞ চললেও বাঘেরা ওই স্থান ত্যাগ করছে না। শেখেরটেক ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রে নির্মাণ কাজে সহায়তা ও শ্রমিকদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য সেখানে চারজন বনরক্ষীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

সুন্দরবনের শেখেরটেক এলাকায় ৪০০ বছরের পুরোনো একটি মন্দিরকে কেন্দ্র করে নতুন পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণ করেছে বন বিভাগ। এরইমধ্যে সেখানে পর্যটকদের যাতায়াতের অনুমতিও দেয়া শুরু হয়েছে। তবে বনরক্ষী ও জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মন্দিরটিতে বছরের পর বছর ধরে বসবাস করে আসছে কয়েকটি বাঘ। আর পর্যটনকেন্দ্র চালু হলেও, বাঘেরা ওই এলাকাটি ছাড়তে চাইছে না।

খুলনা শহর থেকে নদী পথে প্রায় ৮৫ কিলোমিটার দূরে শিবসা নদীর পূর্বের পাড়ে রয়েছে শেখের খাল। তার কিছুটা দূরে এগিয়ে কালির খাল। এই দুই খালের মধ্যেবর্তী স্থানটি শেখেরটেক নামে পরিচিত।

১৬০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মুঘল আমলে ওই মন্দিরটিসহ শেখেরটেক এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছিল একাধিক স্থাপনা।

বন বিভাগ জানায়, সুন্দরবনে অভ্যন্তরে বর্তমানে সাতটি পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে। এগুলো হলো- করমজল, হারবাড়িয়া, কটকা, কচিখালী, দুবলার চর, হিরণ পয়েন্ট ও কলাগাছী। এসব স্থানে প্রতি বছর প্রায় ২ থেকে আড়াই লাখ পর্যটক ভ্রমণ করে। একই স্থানে বেশি পর্যটকের ভিড়ে বনের সার্বিক পরিবেশ ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। তাই ২০২১ সালে নতুন করে আরও চারটি পর্যটন কেন্দ্র তৈরির উদ্যোগ নেয় বন বিভাগ।

এগুলো হলো-সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জের শেখেরটেক ও কালাবগী, শরণখোলা রেঞ্জের আলীবান্ধা ও চাঁদপাই রেঞ্জের আন্ধারমানিক। ২৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয়ে তিন বছর মেয়াদি এসব প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষের পথে রয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, নতুন যে চারটি পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে তার মধ্যে শেখেরটেক ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র পর্যটকদের বেশি আকৃষ্ট করবে।

সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, ‘শেখেরটেক ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ প্রায় শেষের পথে রয়েছে। এরইমধ্যে আমরা সেখানে সীমিত পরিসরে পর্যটদের যাওয়ার অনুমতি দেয়া শুরু করেছি। আগামীতে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের পর পর্যটকদের জন্য পুরোপুরি উন্মুক্ত করা হবে।’

তবে বন গবেষকরা বলছেন, শেখেরটেকে নতুন পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ করার জন্য কোনো ধরনের গবেষণা করেনি বন বিভাগ।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ড. ওয়াসিউল ইসলাম বলেন, ‘শেখেরটেক এলাকায় ইকোট্যুরিজম বা যাই করা হোক না কেন একটা গবেষণা করে কাজ শুরু করা উচিত ছিল। তবে বন বিভাগ এটা করেনি। এরইমধ্যে সেখানে প্রচুর গাছপালা কেটে কংক্রিটের রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। উচিত ছিল পরিকল্পিতভাবে পরিবেশের সঙ্গে ভারসাম্য রেখে পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণ করার।’

বনরক্ষীরা জানিয়েছেন, গত দুই বছর ধরে সেখানে কর্মযজ্ঞ চললেও বাঘেরা ওই স্থান ত্যাগ করছে না। শেখেরটেক ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রে নির্মাণ কাজে সহায়তা ও শ্রমিকদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য সেখানে চারজন বনরক্ষীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

সেখানে দায়িত্বরত বনরক্ষী দীপক কুমার দে বলেন, ‘মন্দিরের কাছে সব সময়ই বাঘ অবস্থান করে। কারণ মন্দিরের জায়গাটা বনের অন্যান্য স্থানের তুলনায় একটু উঁচু। এখানে তিনটি বাঘ রয়েছে। ’

তিনি বলেন, ‘আমরা জানতাম রাতের বেলা আলো দেখলে বাঘ সেখানে আসে না। কিন্তু এখানের বাঘগুলো ক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। প্রতিদিন রাতেই তারা নির্মাণ কাজের আশে পাশে আসছে, সকালে উঠে আমরা পায়ের ছাপ দেখতে পাচ্ছি।’

দীপক কুমার বলেন, ‘নির্মাণ কাজের সময়ে মন্দিরের কাছে কিছু পাইপ ও পলিথিন রাখা হয়েছিল। বাঘেরা সেই পাইপ ভেঙে দূরে নিয়ে ফেলে দিয়েছে, পলিথিন কামড়ে ছিঁড়েছে। মন্দিরটি হয়তো তাদের বাচ্চা প্রসবের ভালো স্থান ছিল। তাদের আস্তানা সংস্কার করা হচ্ছে। তাই তারা অসন্তুষ্ট।’

বনকর্মী বাসার বলেন, ‘এখানে নির্মাণ কাজ চলায় বাঘেরা খুবই আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে। কয়েকদিন আগে নির্মাণ কাজের জন্য কিছু পলিথিন রাখা হয়েছিল মন্দিরের কাছে। রাতে বাঘ সেই পলিথিন ছিঁড়ে খেয়েছে। পরে বাঘের পায়খানায় সেই পলিথিন দেখা গেছে। ’

ওই অঞ্চলের অন্তত ১০ জেলের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক, যারা ইতোপূর্বে বহুবার শেখেরটেক এলাকায় বনজ সম্পদ আহরণ করেছেন। সবাই জানিয়েছেন, ওই মন্দিরটি জেলেদের কাছে বাঘের বাড়ি নামে পরিচিত।

এছাড়া শতাধিক বছর আগে প্রকাশিত সতিশ চন্দ্র মিত্রের লেখা যশোহর-খুলনার ইতিহাস গ্রন্থেও শেখেরটেকে বেশি বাঘ থাকার কথা বলা হয়েছে। বইয়ে লেখা হয়েছে, ‘এখানে সুন্দরী গাছ যথেষ্ট, হরিণের সংখ্যা অত্যন্ত অধিক এবং ব্যাঘ্রাদি (বাঘ) হিংস্র জন্তুর আমদানিও বেশি। সুতরাং আমাদিগকে এক প্রকার প্রাণ হাতে করিয়া এ বনে ভ্রমন করিতে হইয়াছিল।’

সম্প্রতি ওই মন্দিরটি পরিদর্শন করেছেন এই প্রতিবেদক। সেখানে দেখা যায়, শেখেরটেক খাল থেকে মন্দির পর্যন্ত প্রায় সোয়া এক কিলোমিটার কংক্রিটের ফুট ট্রেইল নির্মাণ করা হয়েছে। ওই ফুট ট্রেইলটি মন্দিরের চারপাশ দিয়ে ঘুরিয়ে নেয়া হয়েছে। এছাড়া পর্যটকদের বনের উপরিভাগ দেখার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে একটি ওয়াচ টাওয়ার। বনের মধ্যে কিছু স্থানে ইটের রাস্তাও তৈরি করা হয়েছে। পর্যটকদের সুবিধার্থে একটি টয়লেটের ব্যবস্থাও আছে।’

ওই স্থানে আগ্নেয়াস্ত্রধারী বনরক্ষীদের নিয়ে বেশ কিছু এলাকাও পরিদর্শন করেছেন এই প্রতিবেদক। সেখানে দেখা গেছে, মন্দিরের আশপাশে বাঘের তাজা পায়ের ছাপ।

এ প্রসঙ্গে ড. ওয়াসিউল ইসলাম বলেন, ‘বন বিভাগের উচিত হবে, সেখানে সীমিত পরিসরে পর্যটক পাঠানোর। কারণ পর্যটনের জন্য বনের পরিবেশ নষ্ট বা বাঘদের যন্ত্রণা দেয়া ঠিক হবে না।’

তিনি বলেন, ‘আমি এক সময়ে বন বিভাগে চাকরি করতাম। তখন একটি বাঘ পলিথিন খেয়ে মারা গিয়েছিল। সেখানে পর্যটকরা গেলে বনে অনেক কিছুই ফেলে আসবে। তাই পর্যটক পাঠানোর আগে পরিপূর্ণ নির্দেশনা ছাড়া পাঠানো উচিত হবে না। আর কতজন পর্যটক শেখেরটেকে যেতে পারবে, তা নিয়ে গবেষণা করা জরুরি।’

এ বিভাগের আরো খবর