ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে কিছু বাম দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে ২০০৪ সালে ২৩ দফা ঘোষণা দিয়ে গঠন করে ১৪ দলীয় জোট। অনেক ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার পর এই ১৯ বছরে এসে বিদ্যামান শরিকদের মধ্যে ঐক্য সূদৃঢ় হয়েছে। কিন্তু একের পর এক অভ্যন্তরীণ ভাঙনে পড়েছে শরিক দলগুলো।
আওয়ামী লীগ ছাড়া ১৪ দলের বর্তমান শরিক দলগুলো হলো-বাংলাদেশের ওয়ার্কাস পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), গণতন্ত্রী পার্টি, সাম্যবাদী দল (এমএল), তরিকত ফেডারেশন, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, ন্যাপ (মোজাফফর), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ, রেজাউর), জাতীয় পার্টি (জেপি, মঞ্জু), গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি এবং গণ-আজাদী লীগ।
এগুলোর মধ্যে ওয়ার্কাস পার্টি, জাসদ, গণতন্ত্রী পার্টি, সাম্যবাদী দল, ন্যাপ এবং তরিকত ফেডারেশ ভাঙনের শিকার হয়েছে।
লেখক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেছেন, ‘বাম দলগুলো যখন আওয়ামী লীগ বা বিএনপির মতো বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট করে তখন এগুলো আর বাম দল থাকে না।’
তিনি বলেন, ‘জোটে যাওয়ার পর তাদের ভাঙন হয় স্বার্থকেন্দ্রিক। এ ভাঙন কখনো নিজের দলের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার জন্য, কখনো প্রভাব-প্রতিপত্তি বজায় রাখার জন্য হয়।’
সূত্র জানায়, শুরুতে আওয়ামী লীগ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ও ১১ দলীয় জোট মিলে এই জোট গঠিত হয়। কিন্তু জোট গঠনের পরপরই ১১ দল থেকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ, জামান) সহ কয়েকটি দল বেরিয়ে যায়।
২০০৭ সালের এক-এগারোর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গণফোরাম জোটটি ত্যাগ করে। এ ছাড়া ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জেপি) ও নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীর নেতৃত্বাধীন তরিকত ফেডারেশন জোটে যোগ দেয়।
ওয়ার্কাস পার্টি
এই দলটি ১৪ দলীয় জোটে আসার পরে ভেঙেছে তিন বার। আর জন্ম নেয়ার পরে জোটে আসার আগ পর্যন্ত একবার। ওয়ার্কাস পার্টি ছেড়ে চলে গেছেন দুই প্রবাদপ্রতীম বাম রাজনীতিবিদ হায়দার আকবর খান রনো এবং বিমল বিশ্বাস।
১৯৯২ সালে ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, সাম্যবাদী দল ও ওয়ার্কার্স পার্টির সমন্বয়ে গঠিত হয় বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। ১৯৯৪ সালে টিপু বিশ্বাসের নেতৃত্বে একটি অংশ বেরিয়ে গিয়ে জাতীয় গণফ্রন্ট নামে আলাদা দল গঠন করে।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রশ্নে সৃষ্ট মতবিরোধের জেরে ২০০৪ সালের জুন মাসে সাইফুল হকের নেতৃত্বে একটি অংশ বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি গঠন করে। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ১৪ দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ নির্বাচন ও সরকারে যোগদানের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে দলের পলিটব্যুরোর আরেক সদস্য হায়দার আকবর খান রনোর নেতৃত্বে একটি অংশ দল ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি (পুনর্গঠিত) নামে আলাদা দল গঠন করে।
অবশ্য রনো পরে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে (সিপিবি) যোগ দিয়ে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন। ২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর ওয়ার্কার্স পার্টি ছাড়েন বিমল বিশ্বাস।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মার্কস-লেনিনের আদর্শের কথা বললেও বাস্তবে তার নীতি-কৌশল-সংগঠন এবং তাদের কর্মকাণ্ডে এর প্রতিফলন নেই। পার্টির নেতাদের আদর্শগত-রাজনৈতিক-সাংগঠনিক বিচ্যুতির কারণে দলের প্রাথমিক সদস্যপদ প্রত্যাহার করেছি।’
সর্বশেষ আদর্শগত বিরোধের জেরে ওয়ার্কার্স পার্টির ১০ম কংগ্রেস বর্জন করা নেতারা ২০১৯ সালের ২৯-৩০ নভেম্বর যশোরে ‘বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির’ মতাদর্শ রক্ষা সমন্বয় কমিটির ব্যানারে জাতীয় সম্মেলন করে ১১ সদস্যের নতুন কমিটি গঠন করে।
‘বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি (মার্কসবাদী)’ নামে এ দলের সভাপতি হন নুরুল হাসান ও সাধারণ সম্পাদক পদ পান ইকবাল কবির জাহিদ।
জাসদ
জন্ম থেকেই বহুল বিতর্কিত রাজনৈতিক দলের নাম জাসদ। আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগ দেয়ার অনেক আগে থেকেই বহুধা বিভক্ত হয়ে যায় এই রাজনৈতিক দলটি।
হাসানুল হক ইনু-জাফর সাজ্জাদ নেতৃত্বাধীন কমিটির জাসদ ২০০৪ সালে ১৪ দলীয় জোটে যোগ দেয়। পরে ইনু স্বপদে থাকলেও সাধারণ সম্পাদক হন শরীফ নুরুল আম্বিয়া। ২০১৬ সালে সম্মেলনের সময় আম্বিয়ার স্থলে প্রার্থী হন নাজমুল হক প্রধান। কিন্তু হাসানুল হক ইনুর অংশের নেতাকর্মীরা ইনুর প্রভাব বজায় রাখতে শিরিন আখতারকে সাধারণ সম্পাদক করে ইনু-শিরিন কমিটির প্রস্তাব তোলেন এবং ভোটাভুটিকে পাশ কাটিয়ে কণ্ঠভোটে তা পাশের চেষ্টা করেন।
আম্বিয়া, প্রধান, মাইনুদ্দিন বাদলসহ জাসদের ছয় এমপির চার এমপি মিলে সম্মেলনস্থল ত্যাগ করে প্রেসক্লাবে এসে নতুন দল গড়ার ঘোষণা দেন। নাম দেন বাংলাদেশ জাসদ, যার সভাপতি হন শরীফ নুরুল আম্বিয়া, সাধারণ সম্পাদক নাজমূল হক প্রধান এবং কার্যকরী সভাপতি হন মাইনুদ্দিন খান বাদল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ১৪ দলীয় জোটের নেতারা। ফাইল ছবি
ন্যাপ
প্রতিষ্ঠার পর থেকে সপ্তমবারের মতো ভেঙেছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। তবে এর ছয়টি-ই ১৪ দলে যোগদানের আগের ঘটনা। প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ মোজাফফর আহমেদের ন্যাপ ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় যোগ দেয় ১৪ দলে। বেশ কিছুদিন ঠিকঠাক থাকলেও মোজাফফর আহমেদের মৃত্যুর পর ২০২১ সালে এসে দল ভেঙ যায়। সে বছরের ডিসেম্বরের সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক এনামূল হককে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য করা হয়।
কার্যকরী সভাপতি আমেনা আহমেদ অসুস্থ হলে তাদের মেয়ে আইভী আহমেদকে সভাপতি ঘোষণা দেয়া হয়। এনামূল হক রীতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়ার আহ্বান জানালে তাকেসহ বেশ কয়েকজনকে বহিষ্কার করা হয়। তখন এনামূল হকের নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করা হয়।
এনামূল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দল পরিচালনার পক্ষে অবস্থান নেয়ায় তাকে বহিষ্কার করা হয়। তবে, এখনও মোজাফফর আহমেদের পরিবার চাইলে এক হওয়া সম্ভব।’
গণতন্ত্রী পার্টি
বর্ষীয়ান পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নেতৃত্বে এক দফা ভেঙেছিলো গণতন্ত্রী পার্টি। ১৪ দলে যোগ দেয়ার আগে তৎকালীন সভাপতি আফজাল হোসেনের নেতৃত্বে দ্বিতীয় দফা ভাঙন হলেও আবার ঐক্যবদ্ধ হয় দলটি। কিন্তু এখন গত আট বছর ধরেই আবার ভাঙি ভাঙি করছে গণতন্ত্রী পার্টি।
২০১৪ সালে গণতন্ত্রী পার্টির সম্মেলন হলে ডা. শাহাদৎ হোসেন সাধারণ সম্পাদক হন। কিন্তু দুই বছর পর পর সম্মেলন হওয়ার কথা থাকলেও তিনি সম্মেলন দিতে টালবহানা শুরু করেন। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্ট, সাবজেক্ট কমিটি (নির্বাচনী কমিটি) গঠন ছাড়াই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সাবজেক্ট কমিটি ছাড়াই কমিটি গঠন করতে গেলে হট্টগোল হলে সম্মেলনের অবশিষ্ট কাজ তিন মাস পরে হবে বলে জানান সভাপতি আরস আলী। যদিও ডা. শাহাদৎ হোসেন এটাকে সম্মেলন বলতে নারাজ। তিনি বলেন, ওটা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক ছিলো।
প্রেসিডিয়াম সদস্য নুরুর রহমান সেলিম নিউজবাংলাকে জানান, ওই সম্মেলনে ১৪ দলের আহবায়ক আমির হোসেন আমু, ওয়ার্কাস পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্য আনিসুর রহমান মল্লিক অতিথি ছিলেন। আগামী ১৮ তারিখ সম্মেলনের বাকি কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
সাম্যবাদী দল
২০১৪ সালের জুনে ভেঙ যায় দিলীপ বড়ুয়ার নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী দল। দলের নেতা সাইদ আহমদের নেতৃত্বে সাম্যবাদী দলের একাংশ ২৯ জুন সাম্যবাাদী দল ছেড়ে সাম্যবাদী দল নাম নিয়ে বিএনপি জোটে যোগ দেয়।
যদিও দিলীপ বড়ুয়া নিউজবাংলার কাছে একে ভাঙন বলতে নারাজ। তিনি বলেন, যারা গেছেন ওদের কোনে পদ-পদবি ছিলো না। তারা দলের কেউ ছিলেন না।
তরিকত ফেডারেশন
এ দলটি ঠিক ভেঙে না গেলেও এর প্রথম মহাসচিব এম এ আউয়ালকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয় ২০১৮ সালের এপ্রিলে। পরে এম এ আউয়াল ২০১৯ সালের নভেম্বরে ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টি নামে তিনি আরেকটি দল গঠন করেন। যদিও সেই দল নামে মাত্র টিকে আছে, কেননা খুনের অভিযোগে দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আছেন এম এ আউয়াল।
তরিকত ফেডারেশনের সভাপতি নজিবুল বশর মাইজভান্ডারি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এম এ আউয়াল মূলত একজন ভূমি ব্যবসায়ী। তিনি দলের কার্যালয়ের জমিও আত্মসাৎ করতে চেয়েছিলেন। এছাড়া খুনের অভিযোগে জেল খাটছেন। প্রতারণার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ায় তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।’