মোহাম্মদ শহীদুজ্জামান ওরফে রনি ও মাজহারুল ইসলাম শাকিল সম্পর্কে শ্যালক-দুলাভাই। এই দুই আত্মীয় ডার্ক ওয়েব থেকে তথ্য নিয়ে গড়ে তুলেছেন একটি প্রতারক চক্র।
চক্রটি বিভিন্ন সাইট থেকে ই-মেইল এবং ভিসা, মাস্টারকার্ড, পেপালসহ ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের তথ্য সংগ্রহ করে সেই তথ্যে অনেক প্রতিষ্ঠানের মেইল আইডি হ্যাক করে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পরিবর্তন করে নিজেদের অ্যাকাউন্ট দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছে লাখ লাখ টাকা।
এ ছাড়া শ্যালক-দুলাভাইয়ের চক্রটি বিদেশিদের বিভিন্ন কার্ডের তথ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশের পণ্য অনলাইনে অর্ডার করত। তাদের অর্ডার করা কিছু পণ্য ইতোমধ্যে শিপমেন্টও হয়েছে। কিছু পণ্য শিপমেন্টের অপেক্ষায় রয়েছে। যার বাজারমূল্য ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা।
এ প্রতারক চক্রের প্রতারণার শিকার হয়েছেন জার্মানিতে কারকন কার্গো লিমিটেডের বাংলাদেশ প্রতিনিধি ও কারকন কার্গো কন্ট্রোল বিডির সত্ত্বাধিকারী এম এ আহসানুল বারী। এ নিয়ে গুলশান থানায় একটি মামলা করেন তিনি।
মামলায় আহসানুল বারী অভিযোগ করেন, কেউ তার মেইল আইডি হ্যাক করে জার্মানিতে অবস্থিত মূল কোম্পানির কাছে কোম্পানির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পরিবর্তন করে খরচ বাবদ ৪ হাজার ৮০০ ডলারের ডিমান্ড নোট পাঠিয়ে মেইল করেছে।
তার অভিযোগে তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় আইপি অ্যাড্রেস বিশ্লেষণ করে রোববার ভোরে চাঁদপুর থেকে রনি ও শাকিলকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগ।
যেভাবে প্রতারণা
সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম দক্ষিণের এডিসি (ডিবি) সাইফুর রহমান আজাদ নিউজবাংলাকে বলেন, রনি ডার্ক ওয়েবের বিভিন্ন সাইট থেকে ই-মেইলের তথ্য সংগ্রহ করে। ডার্ক ওয়েব থেকেই জার্মানির কারকন গ্রুপের বাংলাদেশ প্রতিনিধির ই-মেইলের তথ্য পায়। এই তথ্য দিয়ে সে কোম্পানির ই-মেইল অ্যাড্রেসে প্রবেশ করে জার্মানিতে অবস্থিত মূল কোম্পানির কাছে খরচ বাবদ ৪ হাজার ৮০০ ডলার চেয়ে মেইল করে।
তিনি বলেন, মেইলে রনি আগের দেয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পরিবর্তন করে নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য উল্লেখ করে তার অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে অনুরোধ করে। নতুন অ্যাকাউন্ট দেখে জার্মানি থেকে আবারও অ্যাকাউন্টটি কনফার্ম করার জন্য বলা হয়। সে আবার কনফার্ম মেইল পাঠানোর পর তার পাঠানো সব মেইল গুলো অ্যাকাউন্ট থেকে মুছে দেয়। কোম্পানি তার দেয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকাও পাঠিয়ে দেয়।
এর মধ্যে মামলার বাদী বিষয়টি বুঝতে পারলে দ্রুত কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করলে কোম্পানি ‘সুইফট’ সিস্টেম থেকে লেনদেনটি স্থগিত করে দেয় বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
রনি যেভাবে প্রতারক
পুলিশ জানায়, রনির বাড়ি চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড হলেও ঢাকার তেজগাঁওয়ে তার জন্ম। তার জন্মের ৫/৬ বছর পর তার মা-বাবার মধ্যে বিচ্ছেদ হয়। রনি তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়া হোসেন আলী হাই স্কুল থেকে ২০০০ সালে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে ফাস্ট ডিভিশন পেয়ে এসএসসি পাশ করে। ২০০০-২০১৫ সাল পর্যন্ত সে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকের কাজ করে।
এর পর সে ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নেয়। পরে সে অনলাইন ও ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে পুরাতন কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ কেনা-বেচার কাজ শুরু করে।
ডিবির কর্মকর্তা সাইফুর রহমান আজাদ জানান, রনি চক বাজার থেকে কসমেটিকস কিনে ঢাকার গাউছিয়া ও নিউমার্কেটে বিক্রি করত। ২০১৫ সালে বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ি চাঁদপুরের মতলবে বসবাস করতে থাকে। ২০১৯ সাল থেকে শ্বশুর বাড়িতে ঢাকার জুরাইনে বসবাস করতে থাকে এবং পুরাতন কম্পিউটার যন্ত্রাংশ কেনা বেচা শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় হ্যাকারদের সঙ্গে তার সক্ষ্যতা গড়ে ওঠে এবং তাদের কাছ থেকে হ্যাকিং সংক্রান্ত কাজ শেখে।
তিনি বলেন, রনি কম্পিউটার যন্ত্রাংশ কেনা-বেচার পাশাপাশি হ্যাকারদের সঙ্গে অনলাইন প্রতারনায় জড়িয়ে পড়ে এবং অনলাইন প্রতারণার দায়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় অন্য হ্যাকারের সঙ্গে সেও গ্রেপ্তার হয়। ২০২২ সালের ১ আগষ্ট জামিনে মুক্তি পেয়ে তার শ্যালক মাজহারুল ইসলাম ও শাকিলকে নিয়ে আবার ইমেইল এবং ভিসা, মাস্টারকার্ড, পেপালসহ বিভিন্ন ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের তথ্য সংগ্রহ করে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন শুরু করে।
যাদের কাছ থেকে রনি হ্যাকিং শিখেছে তাদের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবির এই কর্মকর্তা জানান, এরকম দুইজনকে তাদের নজরদারিতে রয়েছে। তাদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।