প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর উড়াল মেট্রোরেলের যুগে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। এর এক মাস পর প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরেই বৃহস্পতিবার পাতাল ট্রেনের যুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ।
এই পাতাল রেলপথ নির্মাণ হচ্ছে ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি-১) প্রকল্পের আওতায়। এটি বাস্তবায়ন করবে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।
আজ পূর্বাচল সেক্টর ৪-এ এমআরটি লাইন-১-এর নির্মাণকাজ উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। ওই সময় তিনি জনসমক্ষে উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করবেন। এরপর সুধী সমাবেশে ভাষণ দেবেন সরকারপ্রধান। সেখানে লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হবে।
৫২ হাজার ৫৬১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩১ দশমিক ২৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ এ মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ ২০২৬ সাল নাগাদ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের। তখন এটি দৈনিক ৮ লাখ যাত্রী পরিবহন করতে পারবে বলে জানিয়েছে ডিএমটিসিএল।
এর নির্মাণ ব্যয়ের ৩৯ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা দেবে জাইকা। আর বাকি অর্থ সরকারি তহবিল থেকে মেটানো হবে।
প্রকল্পের নথি বলছে, এমআরটি লাইন-১ রেলপথ হবে উড়াল ও পাতালের সমন্বয়ে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত পাতাল অংশের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৮৭ কিলোমিটার। এ রুটে স্টেশন হবে ১২টি।
এগুলো হলো বিমানবন্দর, বিমানবন্দর টার্মিনাল-৩, খিলক্ষেত, যমুনা ফিউচার পার্ক বা নর্দা, নতুন বাজার, উত্তর বাড্ডা, বাড্ডা, হাতিরঝিল, রামপুরা, মালিবাগ, রাজারবাগ ও কমলাপুর।
অন্যদিকে নতুন বাজার থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত নির্মাণ হবে উড়ালপথ, যার দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৩৬ কিলোমিটার। এ অংশে স্টেশন থাকবে ৯টি, তবে এ রুটে নতুন বাজার ও যমুনা ফিউচার পার্ক বা নর্দা স্টেশন দুটি বিমানবন্দর রুটের অংশ হিসেবে পাতালে নির্মাণ হবে। আর ৭টি স্টেশন হবে উড়াল। এ স্টেশনগুলো হলো বসুন্ধরা, পুলিশ অফিসার্স হাউজিং সোসাইটি, মাস্তুল, পূর্বাচল পশ্চিম, পূর্বাচল সেন্টার, পূর্বাচল পূর্ব, পূর্বাচল টার্মিনাল ও পিতলগঞ্জ ডিপো।
গত মঙ্গলবার রাজধানীর ইস্কাটনে ডিএমটিসিএলের সভাকক্ষে সংবাদ সম্মেলনে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এমএএন ছিদ্দিক বলেন, সকাল ১১টায় পূর্বাচল সেক্টর ৪-এ প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করবেন। এরপর সুধী সমাবেশে ভাষণ দেবেন। সেখানে এক লাখের বেশি লোকসমাগম হবে বলে কর্তৃপক্ষ আশা করছে।
তিনি বলেন, মেট্রোরেলের লাইন-১-এর ডিপো নির্মাণ হবে নারায়ণগঞ্জ জেলার পিতলগঞ্জে। এ কাজের জন্য জাপানের টোকিও কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড ও দেশীয় ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করেছে ডিএমটিসিএল। পুরো প্রকল্পটির কাজ ১২টি প্যাকেজের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হবে।
প্যাকেজে সিপি-১-এর আওতায় ডিপো এলাকায় ভূমি উন্নয়ন করার কাজটি শুরু হবে প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পর, যেখানে ডিপো নির্মাণ করা হবে, সেখানে অনেক উঁচু-নিচু জায়গা আছে। সেগুলো ভরাট করার কাজ শুরু হবে। তারপর সেখানেই ডিপো নির্মাণ করা হবে।
এমএএন ছিদ্দিক বলেন, ‘এমআরটি লাইন-৬-এ আমরা যে কন্ট্রোল সেন্টার থেকে পরিচালনা করছি, সেটা এখন সাড়ে ৩ মিনিট পরপর চলতে পারে। এটাকে আমরা কমিয়ে আনতে পারব। অন্যদিকে, এমআরটি লাইন-১-এ ১০০ সেকেন্ড দিয়ে শুরু করব। এটাকে হেডওয়ে বলে। ১০০ সেকেন্ডের মধ্যে একটার পর আরেকটা ট্রেনে আসবে, এটি আর কমানোর সুযোগ নেই।’
তিনি বলেন, ‘এমআরটি লাইন-১-এর স্টেশনগুলো রাস্তার নিচে তিন তলা হবে। এটি নির্মাণে জনসাধারণের যাতে ভোগান্তি না হয়, সে কথা মাথায় রেখে এখানে আমরা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছি।’
এর আগে ডিএমটিসিএল এমডি বলেছিলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি মাটি খনন করার টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম) আমাদের এখানেই প্রস্তুত করার। তাহলে আমাদের নিজেদের ক্যাপাবিলিটি বাড়বে। এই কাজটি কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত মাটির নিচে ৩০ মিটার আবার কোথাও কোথাও ৭০ মিটার নিচে করা হবে।’
খননকাজের সময় জনসাধারণের চলাচলে কোনো অসুবিধা হবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএমটিসিএলের এমডি বলেন, ‘টিবিএম মেশিন যখন মাটির নিচে কাজ করবে, তখন রাস্তার ওপর বোঝা যাবে না যে, মাটির নিচে কাজ হচ্ছে। সমস্যা একটু হবে স্টেশন নির্মাণের সময়।
‘এই রুটের (পাতাল) যে ১২টি স্টেশন থাকবে, সেখানে আমরা ওপেন কাট পদ্ধতিতে কাজ করব। ওই স্টেশন এলাকায় সর্বোচ্চ ছয় মাস কাজ চলবে। এ সময় আমরা রাস্তার অর্ধেকটা অংশ চালু রেখে বাকি অর্ধেক অংশে কাজ শেষ করব। পরে এই অংশ মাটি ভরাট করে পরের অংশ ধরব। এই ছয় মাস এসব জায়গায় ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট করতে হবে। এ ছাড়া এই কাজে অন্য কোনো জায়গায় ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট করতে হবে না। এমআরটি-৬ নির্মাণে দীর্ঘ সময় যে ভোগান্তি হয়েছিল, এমআরটি-১-এ সেটা হবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই কাজ যেহেতু মাটির ৩০ মিটার নিচে করা হবে, সেহেতু এখানে ইউটিলিটি লাইন সরানোরও কোনো প্রয়োজন হবে না। আর স্টেশন এলাকায় আমরা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করব। এই পদ্ধতির মাধ্যমে স্টেশন এলাকা দিয়ে সামান্য যেসব ইউটিলিটি গেছে, এই ইউটিলিটি যে অবস্থায়ই আছে তাকে সেই অবস্থায়ই রেখে মাটির নিচের দিকে চলে যাব এবং মাটি ভরাট করে দেব।’
এদিকে ডিএমটিসিএলের তথ্য বলছে, এমআরটি-১-এর প্রথমিক কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এরপর ২০২২ সালের ২৩ অক্টোবর এমআরটি-১ প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাপানের বহুজাতিক কনসোর্টিয়ামের নিপ্পন কোয়াই করপোরেশন কোম্পানি জেভির সঙ্গে চুক্তি সই হয়। এই কনসোর্টিয়ামে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে দেশি-বিদেশি আটটি প্রতিষ্ঠান। সেই চুক্তিতে সই করেন ডিএমটিসিএলের এমডি এম এ এন সিদ্দিক এবং নিপ্পন কোয়াই কোম্পানি লিমিটেডের প্রতিনিধি নাও কি কুদো।
এরপর গত বছরের ২৩ নভেম্বর এমআরটি লাইন-১-এর ডিপো এলাকার ভূমি উন্নয়নের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ হয়। তখন বলা হয় এর আওতায় নারায়ণগঞ্জের পিতলগঞ্জ ও ব্রাহ্মণখালী মৌজায় প্রায় ৯২ দশমিক ৯৭২৫ একর জমি অধিগ্রহণে গেজেট প্রকাশ হয়েছে। এর মধ্যে ৩৫ দশমিক ৯০ হেক্টর বা ৮৮ দশমিক ৭১ একর ভূমিতে উন্নয়নকাজ করা হবে। এ কাজের ঠিকাদারিতে রয়েছে জাপানের টোকিও কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড ও বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড।
ডিএমটিসিএল সূত্রে জানা যায়, রাজধানীবাসীকে যানজট থেকে স্বস্তি দিতে সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকা মহানগরী ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ছয়টি মেট্রোরেলের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলবে। এরই মধ্যে ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট-৬ (এমআরটি-৬)-এর উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত উদ্বোধন হয়েছে। এবার কাজ শুরুর হচ্ছে এমআরটি-১।
২০৩০ সালের মধ্যে এই ছয়টি মেট্রো রেলের নির্মাণকাজ পর্যায়ক্রমে তিন ধাপে শেষ হবে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০২৮ সালের মধ্যে এমআরটি লাইন-৫ নর্দান রুটের নির্মাণকাজ শেষ করা হবে।
তৃতীয় পর্যায়ে ২০৩০ সালের মধ্যে এমআরটি লাইন-৫: সাউদার্ন রুট, এমআরটি লাইন-২ এবং এমআরটি লাইন-৪-এর নির্মাণকাজ শেষ করা হবে।