দেশে অনির্বাচিত সরকার আসার পক্ষ নিয়ে বক্তব্য দেয়া তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের তীব্র সমালোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলেছেন, অনির্বাচিত সরকার আসলে মহাভারত অশুদ্ধ না হলেও সংবিধান অশুদ্ধ হয়।
বুধবার বিকেলে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অমর একুশে বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমাদের দেশে খুব জ্ঞানী-বিজ্ঞানী আছেন। তাদের মুখে শুনলাম, দু-চার বছরের জন্য যদি অনির্বাচিত সরকার আসে, তাহলে তো মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। কারা এগুলো বলেন, সেটা আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।
‘অনির্বাচিত সরকার তো আপনারা দেখেছেন। এখানের ছাল ওখানে নিয়ে নানাভাবে দল করার চেষ্টা করেন, রাজনৈতিক নেতাদের খারাপভাবে উপস্থাপন করে অপকর্মের চেষ্টাও করেছেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মহাভারত অশুদ্ধ হবে না, অশুদ্ধ হবে আমাদের সংবিধান। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা এবং তৎপরবর্তী বঙ্গবন্ধুর দেওয়া সংবিধান, অনির্বাচিত সরকার এলে সেটি অশুদ্ধ হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার মনে হয় যেন কিছু লোক আছে তাদের দেশের স্থিতিশীলতা ভালো লাগে না। তাই একটা স্থিতিশীল পরিবেশকে নষ্ট করার অনেক রকম চক্রান্ত হবে, এটাই স্বাভাবিক। যাই হোক, আমি জনগণের ওপর বিশ্বাস করি, জনগণের জন্য কাজ করি আর দেশের সেবা করা এটাই আমাদের লক্ষ্য।’
তিনি বলেন, ‘আমার কথাটা হচ্ছে, কারো যদি ক্ষমতায় যাওয়ার ইচ্ছে থাকে জনগণের কাতারে দাঁড়াবে, নির্বাচন করবে, ভোট করবে, জনগণ যাকে চাইবে তারা ক্ষমতায় আসবে।’
নির্বাচনী ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে আওয়ামী লীগের অবদানের কথা তুলে ধরে দলটির সভাপতি বলেন, ‘নির্বাচনকে সুষ্ঠু করার জন্য আজকের ছবিসহ ভোটার তালিকা, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, আইডি কার্ড, এগুলো তো আমাদেরই প্রস্তাব এবং সেভাবে করা হয়েছে; যেন মানুষ স্বাধীনভাবে তার ভোট দিতে পারে, শান্তিপূর্ণভাবে তার অধিকারটা যেন প্রয়োগ করতে পারে।
‘আমরা সেটাই চাই, সেই ব্যবস্থাটা আমরা কিন্তু করেছি। গণতান্ত্রিক ধারা যাতে অব্যাহত থাকে, তার পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি। আজকে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে বলেই আমরা দেশটাকে উন্নত করতে পেরেছি। পঞ্চদশ সংশোধনী করেছিলাম বলেই কিন্তু আজকে বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা আছে, গণতান্ত্রিক ধারা আছে। আমাদের অনেক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অগ্নি-সন্ত্রাস সাগরে পুড়িয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা এগুলো তো কোনো আন্দোলন হলো না। এগুলো মোকাবিলা করেও কখনো হেফাজতি আন্দোলন, কখনো হলি আর্টিজানের ধাক্কা, সরকার গঠন করার সাথে সাথে বিডিআরের ঘটনা, একটার পর একটা ঘটনা এসেছে; এর সাথে আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সবগুলো মোকাবিলা করেও আমাদের অর্থনীতির গতি আমরা সচল রাখতে সক্ষম হয়েছি। আর দেশে একটা স্থিতিশীলতা আছে।’
নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তারা সিট পাবে কোথা থেকে? হ্যাঁ, আমরা কাজের মধ্য দিয়ে মানুষের সমর্থন আদায় করেছি, এটাতো আর আমাদের অপরাধ না। আমাদের তো প্রচেষ্টাই থাকবে জনগণের জন্য কাজ করা।’
বাস্তব সত্য জেনে মতামত দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনারা অনেক সময় অনেক কিছু শোনেন। আর ডিজিটাল বাংলাদেশ আমরা করেছি যেমন আমাদের সুফল বয়ে এনেছে আবার এর কিছু কুফলও আছে, সন্দেহ নেই। তো যাই দেখেন যাই শুনেন অন্ততপক্ষে বাস্তব চিত্রটা জেনে নিয়ে তারপর একটা মতামত দেবেন।’
আধুনিক প্রযুক্তির যুগেও বই উল্টে পড়ার মজাই আলাদা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখন ডিজিটাল যুগ। ভাষা-সাহিত্য চর্চাও আমরা ডিজিটালাইজড করতে পারি। বইগুলো ডিজিটাল ভার্সনে করতে হবে। অডিও ভার্সনও করা যেতে পারে। প্রত্যেকটা সাহিত্যকর্ম অডিও ভার্সন করতে পারলে চলতে-ফিরতেও শোনা যাবে, পড়া যাবে। সেভাবে আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে আমাদের চলা উচিত। যদিও বই উল্টে পড়ার মজাই আলাদা।’
সরকারপ্রধান অনুবাদের ওপর গুরুত্ব বাড়াতে সংশ্লিষ্টদের আহবান জানান। তিনি বলেন, ‘২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাকে সারাবিশ্বে আরও বিস্তৃত করতে হলে আমাদের সাতিত্যের বেশি বেশি অনুবাদ করতে হবে। তাই প্রতিবছর বের হওয়া উল্লেখযোগ্য বইগুলোর অনুবাদ করতে হবে।’
এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এবং বাংলা একাডেমি উদ্যোগ নিতে পারে বলে মতামত তুলে ধরেন তিনি। পাশাপাশি শিশু সাহিত্যর প্রসারে কাজ করতে এবং জেলায় জেলায় বইমেলা-সাহিত্য মেলা চালিয়ে যাওওয়ার আহবান জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক এই ছাত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তানি শাসকরা আমাদের ওপর উর্দুকে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল, এর প্রতিবাদে ১৯৪৮ সালে ২ মার্চ সলিমউল্লাহ মুসলিম হলে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। একটা বিজাতীয় ভাষা, আবার সেটাকে যখন প্রতিবাদ করা হলো তখন বাংলা ভাষাকে আরবি বা উর্দু হরফে লেখার বাধ্যবাধকতা দেওয়া হলো। সেই অধ্যায় আমাদের দেখতে হয়েছে। আবার পরবর্তীকালে বলা হলো ল্যাটিন হরফে লিখতে হবে। বাঙালি কোনোটাই মানেনি। আমরা সেটা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি, সেটা নিয়ে এগিয়ে যাব।
বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের সভাপতিত্বে বইমেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব আবুল মনসুর, পুস্তক প্রকাশক সমিতির সভাপতি আরিফুর রহমান ছোটন, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহাম্মদ নূরুল হুদা।