গত বছরের ডিসেম্বরে নাগরদোলা থেকে পড়ে গিয়ে নয় বছরের শিশু ফাবিয়ার মাথার বাম পাশের চামড়া পুরোটা উঠে যায়। গুরুতর অবস্থায় তাকে ভর্তি করানো হয় বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। কিন্তু পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় তাকে চিকিৎসকরা তাকে রেফার্ড করে ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। সেখানে এক মাস চিকিৎসার পর ফাবিয়াকে নিয়ে বগুড়ায় ফিরে তার পরিবার।
অথচ বগুড়ায় প্রায় চার বছর আগে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে আধুনিক মানের বার্ন ইউনিট নির্মিত হয়েছে। কিন্তু জনবল বা চিকিৎসা সরঞ্জামাদির অভাবে আজও চালু করতে পারেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি দেয়া পৌনে চার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বার্ন ইউনিটটি অকেজো হয়ে আছে।
তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, জনবল ও চিকিৎসা সরঞ্জামের জন্য নিয়মিত চিঠি পাঠানো হয়।
ফাবিয়ার বাবা মিজানুর রহমান সাধারণ মুদি ব্যবসায়ী। বাড়ি শাজাহানপুরের ডোমনপুকুর এলাকার।
মিজানুর রহমান বলেন, ‘ঢাকায় থেকে মেয়ের চিকিৎসা করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত সোয়া লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। চেকআপের জন্য আবার যাওয়া লাগবে। বগুড়ায় এই সেবা পেলে আর্থিক ও যাতায়াতের কষ্ট অনেক কমে যেত।’
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে পরিবহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এরপর জেলা হাসপাতালগুলোতে বার্ন ইউনিট চালুর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
পরবর্তীতে ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর বগুড়ায় এক জনসভায় মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে আগুনে পোড়া, অ্যাসিডদগ্ধসহ চর্মজনিত সমস্যার রোগীদের চিকিৎসাসেবায় বিশেষায়িত বার্ন ইউনিট স্থাপনের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে ১০ বেডের বার্ন ইউনিট চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় তিন কোটি ৬৩ লাখ টাকা ব্যয়ে মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের উত্তর প্রান্তে একটি অংশে বার্ন ইউনিটের কাজ শুরু হয়। ২০১৯ সালের মে মাসে এর ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শেষ হয়। আর বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ শেষ হয় অক্টোবরে। নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর থেকে জেলা গণপূর্ত বিভাগ চিঠি দিয়ে ইউনিটটি বুঝে নিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানায়। পরবর্তীতে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ভবনটি পুরোপুরি বুঝে নেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
যদিও তার আগে থেকেই করোনা সংক্রমণ বেড়ে গেলে মোহাম্মদ আলী হাসপাতালকে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় বিশেষায়িত হাসপাতাল ঘোষণা করা হয়। তখন বার্ন ইউনিটের ভবনে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (আইসিইউ) স্থাপন করা হয়।
মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের আরএমও শফিক আমিন কাজল বলেন, ‘মহামারির সময়ে জরুরি ভিত্তিতে বার্ন ইউনিটকে করোনার আইসিইউ করা হয়। এখন অবশ্য করোনার রোগি নেই সেখানে। শুধু ইউনিটের সামনে টিকাদান সেবা কার্যক্রম চলে।
হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ জানায়, বার্ন ইউনিটের জন্য তারা মোট ৬৩ জনের পদ সৃজায়ন করে চিঠি পাঠিয়েছে। এর মধ্যে একজন সিনিয়র কনসালটেন্ট, দুইজন করে জুনিয়র কনসালটেন্ট ও সহকারি রেজিস্টার, চারজন করে আইএমও এবং এমও, অবেদনবিদ ২ জন, ১৬ জন সিনিয়র নার্স, ১২ জন করে অফিস সহায়ক ও ওয়ার্ড বয় এবং ৮ জন পরিচ্ছন্নকর্মী। এ ছাড়া সরঞ্জমাদি হিসেবে রয়েছে ১০টি বেড, অপারেশন থিয়েটারসহ বেডের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. এ টি এম নুরুজ্জামান বলেন, ‘বার্ন ইউনিটটির কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর থেকে প্রয়োজনীয় জনবল পাইনি আমরা। ওই সময় থেকেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে নিয়মিত চিঠি দেওয়া হচ্ছে। এমনকি মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো চিঠি বা উত্তর না পাওয়ায় বোঝা যাচ্ছে না কবে নাগাদ ইউনিটটি চালু করা যাবে। তবে তারা আশ্বাস দিচ্ছেন দ্রুত সমস্যা সমাধান হবে।’
বার্ন ইউনিট চালু না হওয়ায় জেলায় এ সংক্রান্ত রোগীর কোনো পরিসংখ্যান নেই মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে। তবে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের একটি অংশে বার্ন ইউনিট করে পোড়া-ক্ষত রোগীদের সেবা দেয়া হয়। কিন্তু এখানে বিশেষায়িত চিকিৎসক ও সরঞ্জাম নেই।
শজিমেক সূত্র জানায়, গত তিন মাসে ১১৫ জন পোড়া-ক্ষত রোগী সেবা নিতে এসেছে হাসপাতালে। তাদের মধ্যে পুরুষ ৩৭ ও নারী ৭৮ জন। সাধারণত শজিমেকের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারির ইউনিটে আগত রোগীর প্রায় ১০ শতাংশকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রেফার্ড করতে হয়।
শজিমেকের উপরিচালক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, ‘আগুনে পোড়া বা চামড়ার সার্জারির রোগীদের অবস্থা গুরুতর হলে রেফার্ড করা হয়। সাধারণ সমস্যার ক্ষেত্রে আমরা চিকিৎসা সেবা দিতে পারি।’