হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে চা বাগান সম্প্রসারণের জন্য কাটা হচ্ছে বড় বড় গাছ। জঙ্গল পরিস্কার করতে ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে আগুন। সেই আগুনে পুড়ে মরছে বন্যপ্রাণী। স্থায়ীভাবে বাসস্থান হারানোর পাশাপাশি এসব বন্যপ্রাণী লোকালয়ে এসে পড়ছে শিকারিদের হাতে।
হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার রশিদপুর বন বিটের আওতাধীন হাতিমারা চা বাগানের গির্জাঘর এলাকায় গত এক সপ্তাহ ধরে এমন ঘটনা ঘটছে।
স্থানীয়রা জানান, হাতিমারা চা বাগান কর্তৃপক্ষ প্রতি বছরই বাগান সম্প্রসারণ করে। চলতি বছর তারা গির্জাঘর এলাকায় বাগান সৃজনের লক্ষ্যে টিলা পরিস্কার শুরু করেছে। গত এক সপ্তাহ ধরে গির্জাঘর এলাকার কয়েকটি টিলা থেকে অন্তত দেড়শতাধিক গাছ কেটে ফেলেছে বাগান কর্তৃপক্ষ। যে গাছগুলোর বয়স ৫০ থেকে ১০০ বছরের বেশি।
গাছ কাটার পর টিলা পরিস্কার করতে ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে আগুন। এতে সেখানে বসবাস করা বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও জীবজন্তু পুড়ে মারা যাচ্ছে। অসংখ্য প্রাণী আহত হয়েছে। স্থায়ীভাবে বাসস্থান হারিয়ে বন্যপ্রাণীরা এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দা জগদীশ গোয়ালা জানান, চা গাছ রোপণের জন্য টিলা পরিস্কার করা হচ্ছে। ১০০ বছরের পুরনো গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। সেখানে ছিল আম, জাম, কাঁঠাল, তেঁতুল, বট, আমলকী, বহেরা, আউলা ইত্যাদি। এ ছাড়াও বন্যপ্রাণীদের খাবারের জোগান দেয়ার মতো অনেক ধরনের গাছ ছিল। সেগুলো কেটে ফেলা হয়েছে।
গির্জাঘর এলাকার মো. নানু মিয়া জানান, যে টিলাগুলোতে আগুন দেয়া হয়েছে সেখানে মায়া হরিণসহ বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রাণী বাস করত। আগুন ধরিয়ে দেয়ার কারণে অনেক প্রাণী পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আহত অবস্থায় সেখান থেকে বেড়িয়ে এসেও অনেক প্রাণী মারা গেছে। কতগুলো যে আহত হয়ে জঙ্গলের ভেতরে গিয়ে মারা গেছে তার কোনো হিসাব নাই।
তিনি আরও জানান, যেগুলো এখনও জীবিত আছে সেগুলো একেবারে নিরুপায়। গাছগুলো কেটে ফেলার কারণে প্রাণীগুলো স্থায়ীভাবে বাসস্থান হারিয়েছে। অনেকগুলো লোকালয়ে এসে শিকারিদের হাতে পড়ে মারা যাচ্ছে। অনেকগুলো খরগোশ ও বন্যশূকর স্থানীয় কিছু লোকজন শিকার করে খেয়ে ফেলেছে।
এম সাইফুর রহমান বলেন, ‘সকালে আহত দুইটি বানর আমার বাড়িতে এসেছে। এর মধ্যে একটা বানরের লেজ অনেকটা পোড়া ছিল। কিন্তু কোথায় যাবে এগুলো? বাগান কর্তৃপক্ষ এটা মোটেও ঠিক করেনি।’
প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন মিতা ফাউন্ডেশনের সমন্বয়কারী রবি কাস্তে বলেন, ‘হাতিমারা চা বাগানের গির্জাঘর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বনাঞ্চল রেমা-কালেঙ্গার কাছাকাছি হওয়ায় এখানে বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণীর বাস। এ ছাড়া মায়া হরিণের পছন্দের জায়গা এটি। এখানে থাকা আউলা নামে একটি গাছের ফল মায়া হরিণ খায়। এ প্রজাতির গাছগুলোও কেটে ফেলা হয়েছে। আগুন লাগিয়ে দেয়ায় অনেক বন্যপ্রাণী পুড়ে মারা যাচ্ছে। বানর, হনুমান, মায়া হরিণ ও শুকরসহ নানা প্রজাতির হাজার হাজার প্রাণী তাদের আশ্রয় হারিয়েছে।
হবিগঞ্জে চা বাগানে গাছ পোড়ানোয় বন্যপ্রাণীরা স্থায়ীভাবে বাসস্থান হারিয়েছে। ছবি : নিউজবাংলা
‘আমরা বাগানের ব্যবস্থাপক মঈন উদ্দিন সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি আমাদের মুখ বন্ধ রাখতে উল্টো হুমকি দেন। পরে আমরা বিষয়টি রশিদপুর বিট কর্মকর্তা ও বিভাগীয় বন কর্মকর্তাকে জানিয়েছি। কিন্তু তিনদিন হয়ে গেলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।’
জঙ্গলে আগুন দেয়া ও গাছ কাটার বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ হলে পরিবেশকর্মী ও সংবাদকর্মীদের তৎপরতার কারণে নতুন করে আগুন লাগানো বন্ধ করে কর্তৃপক্ষ।
এ ব্যাপারে জানতে রোববার হাতিমারা চা বাগানে ঢুকতে বাধা দেন গেট পাহারাদার। এমনকি চা বাগানের ব্যবস্থাপক মঈন উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলতে তার কার্যালয়েও যেতে দেয়া হয়নি। মঈন উদ্দিনের মোবাইলে বারবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
সহকারী ব্যবস্থাপক আসিফ আঞ্জুম চৌধুরী জানান, বাগানের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া তিনি কোনো কথা বলতে পারবেন না।
এ বিষয়ে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘গত তিনদিন ধরে এই বিষয়টি নিয়ে আমার কাছে ফোন আসছে। সেখানে যেহেতু বন্যপ্রাণীদের বাস সেহেতু সেই এলাকায় গাছ কাটা বা আগুন দেয়া বাগান কর্তৃপক্ষের মোটেও ঠিক হয়নি। তবে এ ব্যাপারে আমি বিট কর্মকর্তাকে অবগত করেছি।’
রশিদপুর বন বিট কর্মকর্তা মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি গত কয়েকদিন ধরেই ঘটনাস্থলে আসা-যাওয়া করছি। যে জায়গায় আগুন দেয়া হয়েছে এবং গাছ কাটা হয়েছে সেটি বাগানের নিজস্ব জায়গা। তবে এ ঘটনায় যদি কোনো বন্যপ্রাণী মারা যায় তাহলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব। আমরা বিষয়টি নিয়ে এখনও তদন্ত করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্থানীয়রা আমাদেরকে যে ছবিগুলো দিয়েছেন সেগুলো এ ঘটনার নাকি পুরনো তা পর্যবেক্ষণ করছি। তদন্ত শেষ হওয়ার পরই এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলা যাবে।’