বাতাসে দোল খাওয়া সূর্যমুখী দেখে পাশ দিয়ে ছুটে চলা যে কেউ আনন্দিত হবেন। বাগানে প্রবেশ করলেই মনে হবে হলুদের আভা চারিদিকেই যেন ছড়িয়ে আছে অপার মুগ্ধতা।
এমন মুগ্ধতা দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে হাজারো মানুষ প্রতিদিন ভিড় করছে ফরিদপুর শহরতলীর ডোমরাকান্দি গ্রামের ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পাশে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) এ। এখানেই রয়েছে নজরকাড়া সূর্যমুখীর হলুদ আঙিনা।
সূর্যমুখীর এ বাগানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সব বয়সী মানুষ ছুটে আসছেন সূর্যমুখী ফুল বাগানে। কেউ ছবি তুলছেন, কেউবা মোবাইল ফোনে ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
সূর্যমুখী ফুল বাগানের খবর ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। ফলে জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে নানা বয়সী মানুষ ভিড় করছে এ ফুল বাগানে।
বিএডিসি এর তত্ত্বাবধায়নেই ফরিদপুরের এই সূর্যমুখী বাগান করা হয়। শুধু বীজ সংগ্রহের জন্যই প্রায় একযুগ ধরে এখানে চাষ হচ্ছে সূর্যমুখী। তিন একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এই খামারের সূর্যমুখী সারাদেশের ‘ডাল তেলবীজ’ খামারে বীজ সরবরাহ করা হয়।
আনুমানিক ২০ হাজার সূর্যমুখী ফুলের এ বাগানে সকাল থেকেই দেখা যায় মানুষের আনাগোনা। প্রতিদিনই এই হলুদ হাতছানিতে শামিল হয় শত শত তরুণ-তরুণী।
ফরিদপুর শহরের বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী রাজিউল হাসান নয়ন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সূর্যমুখী ফুলের সৌন্দর্য দেখতে এসেছেন। তিনি জানান, এখানে এসে তার খুবই ভালো লেগেছে। ছবি তুলেছেন, ভিডিও করে তা ছড়িয়ে দিয়েছেন।
মাগুরা জেলার শ্রীপুর থেকে সূর্যমুখীর বাগান দেখতে এসেছেন অলোক সেন নামের এক মোটরপার্টস ব্যবসায়ী। তিনি জানান, ফেসবুকে এ বাগানের ভিডিও দেখে এসেছেন। একসঙ্গে হাজার হাজার সূর্যমুখী ফুল তিনি কখনো দেখেননি। তাই এখানে ছুটে এসেছেন।
শহরের পশ্চিম আলীপুর মহল্লার মাজেদ মিয়া তার ছোট দুই সন্তানকে নিয়ে এ বাগানে এসেছেন। সূর্যমুখী ফুলের সঙ্গে ছবি তুলতে পেরে দারুণ খুশি তারা।
হারোকান্দির এলাকার বাসিন্দা একজন ফুলপ্রেমী আব্দুল্লাহ আল নোমান। প্রতিদিনই এই হলুদের আঙিনায় চোখ বুলাতে হয় তার। তিনি বলেন, ‘ফুল আমার ভালো লাগে। বাড়িতেও আমি ফুলের বাগান করেছি। বাগানে সূর্যমুখী ফুলও রাখব আগামীতে।’
এদিকে সূর্যমুখী ফুল দেখতে লোক সমাগম বেশি হওয়ার কারণে অনেক সময় বিএডিসি এর নিযুক্ত ব্যক্তিদের লোকজনকে সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়। অনেকেই বাগানে ঢুকে ফুল ও গাছ নষ্ট করে ফেলে। কেউ কেউ ফুলের ছবি তোলার জন্য তা ছিঁড়েও ফেলে।
বিএডিসি ডাল ও তৈল বীজ খামারের উপসহকারী পরিচালক রাশেদ খান বলেন, ‘প্রায় এক যুগ ধরে বিএডিসির এ খামারে চাষ করা হচ্ছে সূর্যমুখী ফুলের।
সূর্যমুখী চাষের আবাদ কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দিতেই এমন উদ্যোগ নিয়েছে বিএডিসি। ক্যান্সার, হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রক সূর্যমুখীর রয়েছে নানা পুষ্টিগুণ। এ জন্য দিনকে দিন ফরিদপুরে সূর্যমুখী তেলের চাহিদাও বাড়ছে।’
বিএডিসি এর এ কর্মকর্তা জানান, এ বছর তিন একর জমিতে রোপণ করা হয়েছে সূর্যমুখী ফুল। এখান থেকে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ মণ সূর্যমুখীর বীজ উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। আর এই বীজ সারা দেশে কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া হবে।
চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে ফরিদপুরেও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে সূর্যমুখী ফুলের চাষ।
ফরিদপুরের নয়টি উপজেলায় প্রায় শতাধিক কৃষক চলতি মৌসুমে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করেছেন।
ফরিদপুর সদর উপজেলার হারুকান্দি এলাকার চাষি হুমায়ূন কবির বলেন, ‘অন্য ফসলের চেয়ে খরচ কম ও অধিক লাভ হওয়ার কারণে এই ফুলের চাষ করেছি। আর ফুল দেখতে আসা দর্শনার্থীরাও ভবিষ্যতে সূর্যমুখী ফুল চাষের আগ্রহ প্রকাশ করছেন।’
উপসহকারী পরিচালক মো. রাশেদ খান আরও বলেন, ‘সূর্যমুখী তেলের পুষ্টির শেষ নেই। তাই এ তেলের চাহিদাও বাড়ছে। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই বাড়ানো হচ্ছে সূর্যমুখীর আবাদ। সারা দেশের কৃষকদের মাঝে সূর্যমুখী ফুলের আবাদ ছড়িয়ে দিতে আমরা কাজ করছি। সূর্যমুখীর বীজ কৃষকদের মাঝে সরবরাহ করা হচ্ছে। তাছাড়া সূর্যমুখীর আবাদে নানা রকম কারিগরি সহায়তাও দেয়া হচ্ছে।’
স্থানীয় কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এ বছর ফরিদপুর জেলায় ৫ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখী ফুলের আবাদ করা হয়েছে, যা থেকে প্রায় ১০ টন বীজ উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে।
ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ জিয়াউল হক বলেন, ‘এ ফুলের চাষ নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে বীজ বপনের মাধ্যমে শুরু হয়েছে। বীজ বপনের ৯০ থেকে ১০০ দিনের মধ্যে ফসল তোলা যায়। সামান্য পরিমাণ রাসায়নিক সার ও দুবার সেচ দিতে হয়। প্রতি একর জমিতে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা খরচ হয়। আর এক একর জমির উৎপাদিত বীজ থেকে ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা লাভ করা সম্ভব। সূর্যমুখী গাছ জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করা হয়।’