চাকরি নামের সোনার হরিণের পেছনে না ছুটে নিজেদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা করছেন দিনাজপুরের তিন শিক্ষার্থী। পরিবার থেকে আর টাকা নেবেন না, এ ভাবনায় গড়ে তুলেছেন চায়ের দোকান। নাম দিয়েছেন ‘গ্র্যাজুয়েট চাওয়ালা’।
সম্প্রতি শুরু করা এই চায়ের দোকানে ভিড় করছেন দূরদূরান্ত থেকে আসা অনেকে। ক্রেতাদের সর্বোচ্চ সেবা দিতে চেষ্টা করছেন গ্র্যাজুয়েট চাওয়ালারা। বিক্রেতাদের সেবায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করছেন ক্রেতারা।
দিনাজপুর শহরের মধ্যবর্তী এলাকায় অবস্থিত দেশের সবচেয়ে বড় ঈদগাহ মাঠ গোর-এ শহীদ বড়ময়দান। এই মাঠের চারদিকে বিভিন্ন দোকান ও ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করেন কয়েক শ মানুষ।
তাদের সঙ্গে এবার যুক্ত হলেন এসআর পলিটেকনিক থেকে পাশ করে গ্রাজুয়েট হওয়া চা ওয়ালা দোকানের প্রধান উদ্যোক্তা সুরুজ্জামান ইসলাম সুজন, তার সহপাঠী সাইফুল ইসলাম ও সপ্তম সেমিস্টারের ছাত্র মোজাহিদুল ইসলাম রানা। তাদের বাসা পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলায়।
সরেজমিনে দিনাজপুর গোর-এ শহীদ ময়দানে গিয়ে দেখা যায়, পোড়া মাটির ও প্লাস্টিকের কাপে পরিপাটি করে সাজানো চায়ের দোকানটি। ওই তিন শিক্ষার্থীর কেউ বা চা বানাচ্ছেন, কেউ চা পরিবেশন করছেন চায়ের অপক্ষেমাণ গ্রাহকদের কাছে।
বিকেল ৪টায় শুরু হয় তাদের চা বিক্রির কার্যক্রম যা চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেল হতেই বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর পাশাপাশি পরিবার নিয়ে অনেকেই তাদের দোকানে চা খেতে আসেন। চায়ের মান কেমন, গ্রাহকদের মতামত জানানোর জন্য কাগজে লিখে সেটা বোর্ডে আটকানোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
এখানে প্রতি কাপ গ্রাজুয়েট স্পেশাল চা ১৫ টাকা, ক্লেকাপ চা ২০ টাকা, চকলেট চা ৩০ টাকা, হরলিক্স চা ৩০ টাকা, জাফরানি চা ৫০ টাকা করে বিক্রি হয়। এ ছাড়াও হটকফি ৪০ টাকা, কেপাচিনো কফি ৬০ টাকা ও ফ্রেঞ্চফ্রাই ৪০ টাকা করে বিক্রি হয়।
দিনাজপুর এম. আব্দুর রহিম মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র সালমান রহমান বলেন, ‘একটু ছুটি পেলেই শহরের পাশে বড়মাঠে ঘুরতে আসি। কিন্তু এবার ঘুরতে এসে শহীদ মিনারের সামনে গ্রাজুয়েট চাওয়ালা দেখে আশ্চর্য লাগলো।
‘পরে তাদের সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লাগলো। কারণ তারা পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে। তাদের চা ও ব্যবহার খুবই ভালো লাগলো।’
কৌশিক হোসেন বলেন, ‘তাদের মতো গ্র্যাজুয়েট ছাত্ররা এ ধরনের ব্যবসায় আসতে তা আমি কখনই ধারণা করতে পারি নাই। তবে তারা খুব ভালো করছে। আমি এখন নিয়মিত বন্ধুদের সঙ্গে এখানে আসি।’
দিনাজপুর সদরের বাসিন্দা সাকো রানী দেও বলেন, ‘আমাদের দেশে বর্তমানে চাকরি পাওয়া কষ্টকর। তারা ডিপ্লোমা শেষ করে চায়ের দোকান দিয়েছে। এ রকম অনেকেই আছে যারা পড়ালেখা শেষ করে বেকার হয়ে বসে আছে।
‘এদের দেখে অনেক শিক্ষিত বেকার যুবক নিজে কিছু করতে উৎসাহিত হবে। তারা যে তাদের মেধাকে এখন থেকে ব্যবসায়িকভাবে কাজে লাগাচ্ছে এজন্য তারা অবশ্যই সামনে আরও এগিয়ে যেতে পারবে বলে আশা করি।’
চা ওয়ালা দোকানের প্রধান উদ্যোক্তা সুরুজ্জামান ইসলাম সুজন, ‘একটা ভিন্নধর্মী চিন্তা থেকে আমাদের গ্রাজুয়েট চাওয়ালা শুরু করা। এটা শুরুর করার সময় প্রধান সমস্যা ছিল পরিবারকে বোঝানো। কারণ প্রত্যেকটা পরিবারই চায় তার ছেলে পড়াশোনা করে চাকরি করুক। সেই সমস্যাটা আমাদেরকে মোকাবেলা করতে হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘তারপরও পরিবারের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে আমরা গ্রাজুয়েট চাওয়ালা দোকান দিয়েছি। আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় এ ধরনের কাজকে ছোট হিসেবে দেখা হয়। লোকজন ভাবে, পড়াশোনা করা ছেলেরা কেন চায়ের দোকান দেবে, আর যারা কম শিক্ষিত তারা এই সব কাজ করবে।’
সুরুজ্জামান বলেন, ‘কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশে চাকরি পাওয়া খুবই কষ্ট। অনেকে শিক্ষিত হয়েও বেকার বসে আছে। সেই চিন্তা থেকে আমরা বেকার না বসে থেকে যেন ছোট করে ব্যবসা করে নিজেরা চলতে পারি, এই জন্য গ্র্যাজুয়েট চাওয়ালা দোকান দিয়েছি।’
উদ্যোক্তা মোজাইদুল ইসলাম রানা বলেন, ‘এই মাঠে গড়ে প্রতিদিন ৩-৪ শ কাপ চা বিক্রি হচ্ছে। শুক্রবারসহ অন্য দিনে বিক্রি আরও বেড়ে যায়। আমরা এখানকার আয় থেকে নিজেদের পড়াশোনার খরচ চালাতে পারছি। এতে আমাদের পরিবার থেকে আর টাকা নেয়ার প্রয়োজন পড়ে না।’