পুরান ঢাকার ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে প্রতি বছর পৌষ মাসের শেষ দিন আর মাঘের প্রথম প্রহরে পালিত হয় সাকরাইন উৎসব। রং-বেরঙের ঘুড়ি ওড়ানো থেকে শুরু করে আগুন নিয়ে খেলা, আতশবাজি ও ফানুস ওড়ানোর মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয় সাকরাইন।
পৌষের শেষ দিন শনিবার পালন করা হবে সাকরাইন উৎসব ৷ এ উপলক্ষে সাজতে শুরু করেছে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা। এ দিন পুরান ঢাকার আকাশে নানা রংয়ের কয়েক লাখ ঘুড়ি ওড়ানো হয়। সাকরাইনে ঘুড়ি ওড়ানোর পাশাপাশি সন্ধ্যায় বর্ণিল আতশবাজি ও রং-বেরঙের ফানুসে ছেয়ে যায় বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী শহরের আকাশ।
পুরান ঢাকার মানুষ এটিকে ‘সাকরাইন’ বললেও তা মূলত ‘পৌষসংক্রান্তি’। অনেকের কাছে সাকরাইন ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব নামেও পরিচিত। সাকরাইনকে ঘিরে পুরান ঢাকার অলিতে-গলিতে বেড়েছে ঘুড়ি বেচাকেনার ধুম। শিশু, তরুণ, বৃদ্ধরা কিনছে নাটাই-ঘুড়ি, চলছে সুতায় মাঞ্জা দেয়ার কাজ। এরই পুরান ঢাকার অলি-গলিতে চলছে সাকরাইন উৎসবের শেষ মুহুর্তের প্রস্তুতি।
সূত্রাপুর, নবাবপুর, শ্যামবাজার, ধূপখোলা, শাঁখারি বাজার, তাঁতীবাজার, লক্ষ্মীবাজার, ফরাশগঞ্জ, সদরঘাট, গেন্ডারিয়া, নারিন্দা, লালবাগ, চকবাজার, মুরগীটোলা, ধোলাইখালসহ বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয়েছে সাকরাইনের আমেজ। বিভিন্ন স্থানে শুরু হয়েছে ঘুড়ি বিক্রি এবং শুরু হয়েছে ছাদ সাজানো।
ধূপখোলার ঘুড়ির দোকানগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে নানা ধরনের ঘুড়ি। এর মধ্যে রয়েছে চোখদার, রকদার, গরুদার, ভোমাদার, কাউঠাদার, মাছলেঞ্জা, ফিতালেঞ্জা, একরঙা, চানতারা, সাপঘুড়ি, প্রজাপতি, পেঁচা, বাক্স ঘুড়ি।
আতশবাজির মধ্যে আছে পাঁচ শট, বারো শট, একুশ শট, বত্রিশ শট, আশি শট, একশ বিশ শট, দেড়শ শট, কদম ফুল, তারা শট, ঝর্ণা, ব্যাটারি বোম, চকলেট বোম, শলতা বোম, রকেট বোম, পাতা বোম, ২৮ বোম, ফ্লেম টর্চ। ফানুশেরও মধ্যেও রয়েছে হরেক রকম পদ। পুলিশের ভয়ে অনেকটা লুকিয়ে লুকিয়ে এসব পণ্য বিক্রি করছেন তারা।
প্রতি বছর সাকরাইনে লক্ষাধিক ঘুড়ি বিক্রি করেন শাঁখারি বাজারের ব্যবসায়ীরা। লাখ লাখ টাকার ঘুড়ি, নাটাই, সুতা বিক্রি হয় এই বাজারে। চশমাদার, কাউটাদার, পঙ্খিরাজ, প্রজাপতি, চক্ষুদার, ঈগল, সাদা ঘুড়ি, চারবোয়া, দুই বোয়া, টেক্কা, লাভ ঘুড়ি, ৩ টেক্কা, মালাদার, দাবা ঘুড়ি, বাদুর, চিল, অ্যাংগ্রি বার্ডসসহ নানা আকৃতির ঘুড়ি বিক্রি হয়।
শাঁখারী বাজারের ব্যবসায়ী শঙ্খ শ্রী ভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী তারক রায় বলেন, ‘ভালোই বেচা কেনা চলছে আমাদের। আমাদের পাইকারি কাস্টমার বেশি। ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে ক্রেতারা এসে ঘুড়ি নিয়ে যান। দোকানে ৮ থেকে ১০ রকমের ঘুড়ি রয়েছে। নাটাই, সুতা ও ভালোই বিক্রি হচ্ছে।’
রাধামাধব ভাণ্ডার শ্রী কাক্কেশ্বর জানান, অর্ডার কমে গেছে, তারপরও মোটামুটি চলছে। সারা বছর ঘুড়ি-নাটাইয়ের ব্যবসা করেন তারা। সাকরাইন উপলক্ষে অন্যরকম আমেজ সৃষ্টি হয় ব্যবসায়। তাদের মূল ক্রেতা তরুণ-তরুণী। এবার অর্থনৈতিক মন্দার কারণে পরিবার থেকে শিশুদের হাতে সেভাবে টাকা দেয়া হচ্ছে না।
এক শিশু সাকরাইনে ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য নাটাই কিনতে এসেছে। ছবি: নিউজবাংলা
শাঁখারি বাজারে গেন্ডারিয়া থেকে ঘুড়ি কিনতে আসা রাসেল ও তার বন্ধু আল আমীন জানান, তাদের কাছে এই উৎসব অনেক ভালো লাগে। প্রতি বছর জানুয়ারি মাস আসলে আনন্দ লাগে। বন্ধুদের সঙ্গে ঘুড়ি ওড়াতে, কাটাকাটি করতে তাদের ভালো লাগে।
ধোলাইখাল থেকে মোস্তাকিন আহমেদ তার সন্তানকে নিয়ে বাংলাবাজার এসেছেন । তিনি বলেন, ‘এক সময় আমরা ঘুড়ি উড়িয়েছি। এখন আমাদের বাচ্চাদের সময়, তাই তাদের জন্য প্রতিবছর ঘুড়ি কিনে দিতে হয়।’
সূত্রাপুর অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা বাদল মুন্সি বলেন, ‘পুরান ঢাকার সাকরাইন একটি ঐতিহ্য যা ১৭০০ সালের পর থেকে প্রচলিত হয়ে আসছে। ১৪ই জানুয়ারি প্রতি বছর উৎসবটি পালন করা হয়ে থাকে। আমরা সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছি, এটা আমাদের কাছে আনন্দের দিন। আমরা ঢাকাইয়ারা সব সময় এই ঐতিহ্যকে আগামী প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দিতে চাই।’
পুরান ঢাকার বাবুবাজার-আরমানীটোলা সমাজ কল্যাণ সংসদের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন জানান, পুরান ঢাকায় ঘুড়ি ওড়িয়ে সাকরাইন উৎসব পালন করা একটি ঐতিহ্যবাহী রেওয়াজ। তবে এর মধ্যে ফানুস ওড়ানোর কারণে অনেক সময় অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এ জন্য ফানুস ওড়াতে ও আতশবাজি নিষিদ্ধ করা উচিত। এ ছাড়া অপসংস্কৃতির চর্চাও উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক জানান, সাকরাইন উৎসবে রাজধানীবাসী যাতে ফানুস ওড়াতে না পারেন এবং দোকানিরা যাতে ফানুস বিক্রি করতে না পারেন সে বিষয়ে থানায় থানায় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।