মুন্সীগঞ্জ সদরের চরকেওয়ারে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি হামলার ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও গ্রামছাড়া খাসকান্দি ও ছোট মোল্লাকান্দি এলাকার নারী-পুরুষ এবং স্কুলগামী শিশুসহ দুই শতাধিক মানুষ।
চরকেওয়ার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান আক্তারুজ্জামান জীবন সমর্থিত মামুন হাওলাদার পক্ষের লোকজনের সঙ্গে বর্তমান চেয়ারম্যান আফসার উদ্দিন ভূঁইয়া সমর্থিত আহম্মদ হোসেন পক্ষের লোকজনের সংঘর্ষের জের ধরে বাড়িতে যেতে পারছেন না বলে দাবি করেছেন অনেকে।
২০২১ সালের ২৮ নভেম্বরের ইউপি নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের জের ধরে এ দুই পক্ষের মধ্যে একাধিকবার সংঘর্ষ হয়। সবশেষ ২০২২ সালের ১০ জুলাই ঈদুল আজহার পরদিন আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে খাসকান্দি ও ছোট মোল্লাকান্দি এলাকায় সংঘর্ষে জড়ায় দুই পক্ষ।
ওই সময় গুলিবিদ্ধ হয় উভয় পক্ষের অন্তত ১০ জন। এ ঘটনায় মুন্সীগঞ্জ সদর থানায় ৫১ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। মামলার পর থেকে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হন এজাহারে থাকা আসামিসহ অন্তত ৬০ জন এবং তাদের পরিবারের দুই শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু।
খাসকান্দি এলাকার কোহিনুর বেগম জানান, তার নাতি স্থানীয় কদমতলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। এ দুই পক্ষের মারামারির ফলে সে পরিবারসহ এলাকাছাড়া হওয়ায় ৬ মাস ধরে স্কুলে যেতে পারছে না। তার লেখাপড়া বন্ধ রয়েছে।
খাসকান্দি এলাকার মজিবুর রহমান বেপারী বলেন, ‘খাসকান্দি এলাকায় আমার চৌচালা ঘর ছিল। মামলার পর থেকে আমি গ্রামছাড়া। আমার বাড়ির টিউবওয়েল তারা তুলে নিয়ে গেছে। বিল্ডিংয়ের থাই গ্লাস ভেঙে ফেলেছে। নির্বিচারে তারা বাড়ি থেকে বিভিন্ন দ্রব্য লুটপাট করে নিয়ে গেছে।’
ছোট মোল্লাকান্দি এলাকার হাজি সৈয়দ আহম্মেদ খাঁ বলেন, ‘আমি প্রতি বছর সাড়ে তিন বিঘা জমিতে আলু চাষ করি। এ বছর মামুন হাওলাদার ও তার লোকজনের বাধার কারণে জমি চাষ করতে পারিনি। আমিসহ স্থানীয় আরও ৬০টি পরিবার বাড়িছাড়া। ২০০ থেকে ৩০০ মানুষ গ্রামছাড়া।
‘মামুনের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করা হলেও পুলিশ নেয় না। অথচ আমরা ঘটনাস্থলে না থাকলেও পুলিশ হুকুমের আসামি করে।’
এ বিষয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আহম্মদ হোসেন বলেন, ‘দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের সময় আমি এলাকায় ছিলাম না। তার পরও আমার বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে। সংঘর্ষের ঘটনায় আমাদের পক্ষেরও চারজনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমরাও মামুন হাওলাদারের পক্ষের লোকজনের বিরুদ্ধে মামলা করি। এ নিয়ে কয়েক দফায় আপস-মীমাংসার চেষ্টা করা হলেও তা হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘মামুনের লোকজন আমাদের এলাকায় যেতে বাধা দিচ্ছে। তারা আমাদের জমিতে চাষাবাদ করতে দিচ্ছে না। ফলে আলুর মৌসুম শেষ হতে চললেও আমরা আমাদের জমিতে আলু চাষ করতে পারছি না।’
অভিযোগের বিষয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মামুন হাওলাদার বলেন, ‘আমার গ্রামের বাড়ি ছোট মোল্লাকান্দি হলেও আমি ঢাকায় বসবাস করি। বেশ কয়েক বছর ধরেই স্থানীয় দুই পক্ষের লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষ চলে আসছে। সংঘর্ষের ঘটনায় অনেকের অঙ্গহানিও ঘটেছে।
‘জমিতে চাষাবাদ যারা করতে পারেননি, তারা ভয়ে নিজেরাই এলাকায় আসছেন না। তারা কেন আসছেন না আমার জানা নেই।’
কী বলছেন দুই চেয়ারম্যান
চরকেওয়ার ইউপি চেয়ারম্যান আফসার উদ্দিন ভুঁইয়া বলেন, ‘চরকেওয়ার ইউনিয়নের খাসকান্দি ও ছোট মোল্লাকান্দি এলাকার দীর্ঘদিনের বংশগত বিরোধের জের ধরে এখানে প্রায়ই সহিংস ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ নির্বাচনের সময় এ বিরোধ আরও চরম আকার ধারণ করে। নির্বাচনে আমি নৌকা প্রতীক পেলে আহম্মদরা আমার পক্ষে কাজ করে।
‘অন্যদিকে মামুনরা স্বতন্ত্র প্রার্থী আক্তারুজ্জামান জীবনের পক্ষ হয়ে নির্বাচন করে। দুই পক্ষেরই অন্তত ১৫টি করে ৩০টি মামলা রয়েছে, তবে এ এলাকায় যাই ঘটুক, মামুনের বিরুদ্ধে পুলিশ কোনো মামলা নেয় না। পুলিশের এক বড় কর্মকর্তা মামুনের আত্মীয়, যার জন্য সে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকলেও তাকে মামলার আসামি করা হয় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘সবশেষ দুই পক্ষকে নিয়ে জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে মীমাংসার জন্য বসা হয়। সেখানে পরবর্তী সিদ্ধান্তের জন্য জীবন ও মামুনকে দায়িত্ব দেয়া হলেও তারা পরে আর কোনো উদ্যোগ নেয়নি।’
সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও জেলা পরিষদ সদস্য আক্তারুজ্জামান জীবন বলেন, ‘এসব ঘটনা মীমাংসার জন্য আমরা সম্প্রতি জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে উভয় পক্ষকে নিয়ে বসি। সেখানে উভয় পক্ষ আর সহিংসতায় না জড়ানোর প্রতিজ্ঞা করে। এরপর থেকে এলাকায় সহিংসতা বন্ধ রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না, টিউবওয়েল খুলে নিয়ে গেছে, অনাবাদি জমিতে চাষাবাদ করতে পারে না- এসব অভিযোগ মিথ্যা।’
পুলিশের ভাষ্য
মুন্সীগঞ্জ সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থান্দার খায়রুল হাসান বলেন, ‘চরকেওয়ার ইউনিয়নের খাসকান্দি ও ছোট মোল্লাকান্দি এলাকার কিছু লোক গ্রামছাড়া, সেটি আমরা জানি। তারা ভয়ে এলাকায় যাচ্ছেন না বলে আমরা শুনেছি। তাদের কেউ মারধর করেনি।
‘ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে এ রকম কোনো অভিযোগও আমরা পাইনি। আগামী এক মাসের মধ্যে চরাঞ্চলের সব সহিংসতা বন্ধ করতে কাজ করছি।’
জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অর্থ ও প্রশাসন) সুমন দেব বলেন, ‘মামুন হাওলাদার কার আত্মীয়, সেটি আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। পুলিশের কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও আমাদের বলেনি, সে কারও আত্মীয়।
‘থানায় তার বিরুদ্ধে কেন মামলা হয় না, সেটি এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না, তবে সে প্রকৃত অপরাধী হয়ে থাকলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই মামলা নেয়া হবে।’