একাদশ সংসদ নির্বাচনের মতো দ্বাদশেও অংশগ্রহণমূলক ভোটের প্রত্যাশা করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলেছেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের সহযোগিতা দেবে সরকার।
চলতি বছরের শেষে অথবা সামনের বছরের শুরুতেই জাতীয় নির্বাচন হবে জানিয়ে তিনি এও বলেন যে, একটি গোষ্ঠী পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করছে।
নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি পূরণ না হলে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনের মতো ভোট বর্জনের আগাম ঘোষণার মধ্যে জাতির উদ্দেশে ভাষণে এই আশার কথা বললেন সরকারপ্রধান।
সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের চতুর্থ বছর পূর্তিতে শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এই ভাষণ প্রচার হয়। আগে থেকে রেকর্ড করা ভাষণটি দেশের সব কটি টেলিভিশন চ্যানেল সরাসরি সম্প্রচার করে।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট শেষে ২০১৯ সালের ৬ জানুয়ারি শপথ নেয় শেখ হাসিনার টানা তৃতীয় মেয়াদের সরকার।
আগামী নির্বাচনের এক বছরের মতো সময় বাকি থাকলেও এখনও ভোটের হাওয়া তৈরি হয়নি। বরং নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বিরোধী পক্ষের অবস্থানের কারণে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচন পূরবর্তী সহিংসতার শঙ্কার কথা বলাবলি হচ্ছে।
গত বুধ ও বৃহস্পতিবার পুলিশ সপ্তাহে বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীও এই প্রসঙ্গ টানেন। বলেন, ২০১৩ থেকে ১৫ সালের মতো পরিস্থিতি কাউকে করতে দেয়া হবে না।
জাতির উদ্দেশে ভাষণে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের প্রত্যাশা করছি।’
সরকার সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের সহায়তা দিয়ে যাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য বাংলাদেশে এই প্রথম একটি আইন পাস করা হয়েছে। সেই আইনের আওতায় সার্চ কমিটি করে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে আর্থিক স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে।’
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে একটি রিট আবেদনের শুনানি শেষে ২০১১ সালের প্রথম প্রান্তিকে উচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ঘোষণার পর ওই বছর নির্বাচিত সরকারের অধীনে ভোটের ব্যবস্থা ফেরায় আওয়ামী লীগ সরকার।
এর প্রতিবাদে ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। সেই সঙ্গে সেই নির্বাচন বানচালে যায় আন্দোলনে। তবে বিরোধীদের বর্জনের মুখে একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতায় ফেরে আওয়ামী লীগ।
একতরফা নির্বাচন করেছে জাতীয় পার্টি এবং বিএনপিও। তবে তাদের সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির সরকার দুই বছরের কিছু বেশি সময় এবং ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটের পর বিএনপি সরকার টিকে থাকে অল্প কদিন।
তবে আওয়ামী লীগ সরকার মেয়াদ পূর্তি করে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন দেয়। সেই নির্বাচনের আগে আবার আন্দোলনের ঘোষণা দিলেও তাতে অংশ নেয় বিএনপি। ২০-দলীয় জোটের পাশাপাশি গড়ে তোলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে আরও একটি জোট।
তবে সেই নির্বাচনে আগের রাতেই ভোট হয়ে যাওয়ার অভিযোগ এনে আবার তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ফিরে গেছে। আর আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধীদের এই দাবি নাকচ করে এমনকি আলোচনায় না বসার কথাও বলছে। তারা বলছে, উচ্চ আদালত এবং জাতীয় সংসদ- দুই জায়গাতেই তত্ত্বাবধায়কের বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। সেটি ফেরার আর সুযোগ নেই।
‘পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসার চেষ্টা চলছে’
জাতির উদ্দেশে ভাষণে বিরোধীদের এই দাবি নিয়ে একটি বাক্যও খরচ করেননি প্রধানমন্ত্রী। তবে পরোক্ষভাবে তিনি তার সরকারের অবস্থানও তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, ‘এ বছরের শেষে অথবা সামনের বছরের শুরুতেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু এখন থেকেই স্বাধীনতাবিরোধী, ক্ষমতালোভী, জনগণের সম্পদ লুণ্ঠনকারী আর পরগাছা গোষ্ঠীর সরব তৎপরতা শুরু হয়েছে। এদের লক্ষ্য ঘোলাটে পরিস্থিতি সৃষ্টি করে পিছনের দরজা দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করা। গণতন্ত্রেও অগ্রযাত্রা ব্যাহত করা।
‘এরা লুণ্ঠন করা অর্থ দিয়ে দেশে-বিদেশে ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী এবং বিবৃতিজীবী নিয়োগ করেছে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়ে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এরা মিথ্যে এবং ভুয়া তথ্য দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। এদের মিথ্যাচারে বিভ্রান্ত হবেন না।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলসমূহ এবং প্রতিষ্ঠানের প্রতি অনুরোধ, সাংবিধানিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় এমন কোনো উদ্ভট ধারণাকে প্রশ্রয় দেবেন না এবং ইন্ধন যোগাবেন না।’
নির্বাচনে বিজয়ী না হলেও জনগণের সেবা করে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ জনগণের দল, জনগণের শান্তিতে বিশ্বাসী, জনগণের শক্তিতে বিশ্বাসী। জনগণ ভোট দিয়ে বিজয়ী করলে আওয়ামী লীগ দেশ গড়ার জাতীয় দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখবে। যদি বিজয়ী না করে, তাহলে আমরা জনগণের কাতারে চলে যাব। তবে, যেখানেই থাকি, আমরা জনগণের সেবা করে যাব।
‘কিন্তু ষড়যন্ত্র করে কেউ যাতে জনগণের অধিকার কেড়ে নিতে না পারে, সেদিকে সকলের সজাগ দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানাচ্ছি। একইসঙ্গে, কেউ যাতে আন্দোলনের নামে অরাজকতা সৃষ্টি করে মানুষের জানমালের এবং জীবিকার ক্ষতিসাধন করতে না পারে, সেদিকে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।’
পরবর্তী লক্ষ্য স্মার্ট বাংলাদেশ
ভাষণে দেশ নিয়ে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যত ভাবনার কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশ এগিয়েছে অনেক। তবে আরও এগিয়ে নিতে হবে। একটি উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ অর্জন আমাদের লক্ষ্য। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পর আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য হলো স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের নানা অনুসঙ্গ ধারণ করে আমরা তরুণদের প্রশিক্ষিত করে তোলার উদ্যোগ নিয়েছি।
‘স্মার্ট বাংলাদেশ, স্মার্ট গভার্মেন্ট, স্মার্ট জনগোষ্ঠী, স্মার্ট শিল্প কলকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাণিজ্যি, কৃষিসহ সকল ক্ষেত্রে রোবোটিকস, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ন্যানো টেকনোলজি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, জৈব প্রযুক্তি অর্থাৎ ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। সকল ক্ষেত্রে গবেষণার উপর জোর দেয়া হয়েছে।’
‘আমরা কী দিয়েছি বিচার বিশ্লেষণ করুন’
২০০৯ সাল থেকে একটানা ১৪ বছর আওয়ামী লীগ সরকার দেশ এবং দেশের জনগণকে কী দিতে পেরেছে, তার বিচার-বিশ্লেষণ করতেও জনগণের প্রতি অনুরোধ রাখেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘বর্ষপূর্তিতে আমি শুধু কয়েকটি বিষয়ে আলোকপাত করে আপনাদের স্মৃতিকে নাড়া দিতে চাই।’
২০০৯ সালে আমরা যখন সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেন, তখন বিশ্বব্যাপী মন্দা থাকার বিষয়টি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ছিল আকাশচুম্বী, অন্যদিকে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ছিল নিম্নমুখী।
‘বিদ্যুতের অভাবে দিনের পর দিন লোডশেডিং চলত। গ্যাসের অভাবে শিল্পকারখানার মালিকেরা যেমন হাহাকার করত, তেমনি চুলা জ্বলত না মানুষের বাড়িতে। সারসহ কৃষি উপকরণের উচ্চমূল্য এবং জ্বালানি তেলের অভাবে কৃষকের নাভিশ্বাস উঠেছিল। এমনি এক অর্থনৈতিক দূরবস্থার মধ্যে আমরা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেই।’
শেখ হাসিনা জানান, ভোটের আগে দেয়া ইশতেহারের আলোকে তারা স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে এগিয়ে নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। স্থবির অর্থনীতিকে সচল করতে কৃষি, জ্বালানি, বিদ্যুৎসহ কয়েকটি খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে আমরা কাজ শুরু করেন।
নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বেশ কয়েকটি ছোট বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা, রাসায়নিক সারের দাম কমিয়ে দেয়া এবং প্রতিটি খাতে আমরা পরিকল্পিত উন্নয়ন নিশ্চিত করার উদ্যোগের কথা বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার সুফল জনগণ আজ পেতে শুরু করেছে। আজ দেশের শতভাগ মানুষ বিদ্যুতের আওতায়। নিজস্ব গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি বর্ধিত চাহিদা মেটানোর জন্য আমরা এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করে এলএনজি আমদানির ব্যবস্থা নিয়েছি। প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত আজ মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে গ্যাসের চুলায় রান্না হয়।’
নিজ অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ, মেট্রোরেল উদ্বোধনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘কিছুদিনের মধ্যেই শুধু বাংলাদেশেই নয়, চট্টগ্রামে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম পাতাল সড়কপথ- বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধনের মাধ্যমে আরেকটি মাইলফলক স্থাপিত হবে। পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে।’
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, মাথাপিছু আয়সহ অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে বর্তমান সরকারের আমলের চিত্রের তুলনাও করেন শেখ হাসিনা।