জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ সদর ইউনিয়নের খড়মাপাড়ার বাসিন্দা ফুল বেগম। চোরের ভয়ে তার গরুগুলো রেখেছিলেন পাকা দালানে। তবুও রেহাই পাননি তিনি। সম্প্রতি রাতের আঁধারে তার গোয়াল ঘরের তালা কেটে চারটি গরু চুরি করে নিয়ে যায় সংঘবদ্ধ চোরচক্র। ঘটনার পর থেকেই চুরি হওয়া গরুর খোঁজে পাগলের মতো ছুটে বেড়াচ্ছেন তিনি। গোয়ালঘরে থাকা গরুর খাবারগুলো শেষ স্মৃতি তার। সব কিছুর বিনিময়ে হলেও নিজের গরু ফিরে পেতে চান ফুল বেগম।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে ফুল বেগম বলেন, ‘এহন আমার গরু চারডেই আমি চাই। আমি খুব পরিশ্রম করছি, খুব কষ্ট করছি ভাই। আমার খুব দুঃখ লাগছে। আমার পালিত গরু নিয়ে গেল গা। সারা দিন ভাই পান ছাড়া কিছু খাই নাই। আমি তার জন্যেই কইলাম থানায় এডা জিডি করে থুয়ে আসো। আমার আরেকবার গরু নিয়ে গেছিল বাড়াইছিল। আরেকবার নিয়ে গেছে বাড়াই নাই। এইবারও এইভাবে নিয়ে গেল গা চারডে গরু।’
শুধু ফুল বেগম নয়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় গত এক মাসে দেওয়ানগঞ্জ সদর ইউনিয়নের বাসিন্দা আইয়ুব আলীর একটি, জরিনা বেগমের একটি, সাখাওয়াত হোসেনের একটি গরুসহ প্রায় অর্ধশত গরু চুরির ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
সদর ইউনিয়নের বাসিন্দা জরিনা বেগম বলেন, ‘ব্যাংক থাইকে টেহা তুলছিলাম। কিস্তির পর। টেহা তুইলে গরু কিনছিলাম। চুরে নিয়ে গেলগা। নেয়ার পরে এহন তো আমি আর গরু কিনবের পাইতাছি না। চুরের ভয়ে আমি আর গরু কিনবার পাইতাছি না। গরু পালা বাদ দিছি।’
আরেক বাসিন্দা ফিরোজা বেগম বলেন, ‘আমার চুরে যাওয়া গরুডার জন্যে সারাটা দিন আমার কান্দনের পর দিন যাই। রাত যা আমার কান্দনের পর। আমার মহিষের নাহালা গরু। ওই গরুর দুধ বেইচে আমি ওষুধ খাইতাম। এহন গরুও নাই ওষুধও খাবার পাই নে।’
স্থানীয়রা বলছে, প্রতি বছর শীত আর বন্যার সময়ে বাড়ে এই অঞ্চলে চোরের উপদ্রব। তাই এই সময়ে চোরের ভয়ে গরু লালন-পালন থেকে বিরত থাকছেন তারা। এতে সংসারে বাড়তি আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা।
সদর ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান খন্দকার এনামুল হক বলেন, ‘প্রায়ই শীতকালীন আর বর্ষাকালীন দুই সময়ই গরু চুরি হয়। তার মধ্যে শীতকালীনডাই বেশি হয়। গত বছর আমার নিজস্ব পাঁচ লাখ টাকার সাতটা গরু নিয়ে গেছে। এর জন্যে আমি গরু পালাই বন্ধ কইরে দিছি এবং আমার এলাকায় নিরীহ যে লোকগুলো আছে, যারা বাৎসরিকভাবে গরু পালে, এরাও হতাশাগ্রস্ত। এরাও গরু পালা বন্ধ কইরে দিতাছে শুধু চুরের উপদ্রবে।’
স্থানীয় বাসিন্দা এরশাদ আলী বলেন, ‘কয়েক দিন ধইরে যে গরু-টরু হারাইতাছে। এহন আঙ্গর তো গরু-বাছুর পাইলে একটু চলতে হবে। চুরের ভয়ে যদি আমরা গরুই না পালতে পারি, তাহলে আমরা কিভাবে বাঁচমু।’
গরু চুরি ঠেকাতে রাত জেগে গোয়ালঘর পাহারা দিতে হচ্ছে স্থানীয়দের।
সাখওয়াত হোসেন নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘কয়েক দিন আগে রাতের বেলা আমার তিনডা গরু চুরি করে নিয়ে যাওয়ার সময় দুইটা গরু ফেলে রেখে চলে যায়, আরেকটা নিয়ে যায় চোরেরা। এহন গরু চুরির অবস্থা যে গোয়ালঘরে না থাইকে আর কোনো অবস্থায় নাই। আমাদের সারারাত এভাবে জাইগে থাইকে পাহারা দেয়া লাগতাছে।’
বিপুলসংখ্যক গরু চুরির ঘটনা ঘটলেও অতীতে কোনো গরু উদ্ধার না হওয়াসহ পুলিশের নীরব ভূমিকার কারণে আইনি পদক্ষেপ নিতে তেমন আগ্রহ নেই ক্ষতিগ্রস্ত গরু মালিকদের।
দেওয়ানগঞ্জ সদর ইউনিয়নের গ্রাম পুলিশ জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘শীত আর বন্যা এলেই এই গরু চুরিডা বৃদ্ধি বেশি হয়। এহন এলাকার লোক এডে বুঝতাছে না। মামলা করলে কি বা জিডি করলে সার্বিক সহযোগিতা পাব। এই সম্বন্ধে তারা বুঝে না।’
মালা বেগম নামের একজন বলেন, ‘কোনো গরু চুরির পর থানায় অভিযোগ দিলে পুলিশ এক দিন আইসে ঘুইরে যায়। আর আসে না, আর এক দিনও আসে না। কোনো খবরবার্তাও থাকে না। আমরা এহন কই যামু।’
দেওয়ানগঞ্জ সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সায়দুজ্জামান খান বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে ইদানীং চুরির উপদ্রব বেশি বাড়ছে। গতকাল চারডে গরু নিছে। এক মাসের মধ্যে ৩০ থেকে ৩৫টা গরু চুরে নিছে।
‘তাতে যদি পুলিশের টহলডা বাড়াই দেয়া হয়। কোনো পদক্ষেপ নেই। পুরাতন চুরদের ধরে নিয়ে চালান দেয়া হয়। তাহলে মনে হয় যে, এই ইউনিয়ন থেকে গরু চুরির উপদ্রবটা কমে যাব গা। একচুয়ালি পুলিশ প্রশাসন শিথিলের মতো।’
পুলিশ বলছে, এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ না আসায় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছেন না তারা। তাই ঘটনা ঘটার সঙ্গে থানায় অভিযোগ দেয়ার পরামর্শ পুলিশের।
এসব বিষয়ে দেওয়ানগঞ্জ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শ্যামল চন্দ্র ধর বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাদের ৮ নম্বর ইউনিয়ন বা দেওয়ানগঞ্জ থানায় কোনো ধরনের গরু চুরির সংবাদ আমি পাই নাই। কোনো ব্যক্তি অভিযোগ আমার কাছে করে নাই এবং গরু চুরি হইলে বা যেকোনো ধরনের অপরাধের ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে আমি তাদের আহ্বান জানাই। তারা আসুক, আমাদের অভিযোগ দেক। আমরা আইনি ব্যবস্থা নিব।’