বগুড়া সকাল থেকে ঘন কুয়াশায় ঢাকা। দুপুর ১২টা পেরোলেও সূর্যের দেখা মেলেনি। শহরের মফিজ পাগলার মোড়ের সামনে দিয়ে কাঁধে ভার নিয়ে যাচ্ছিলেন ভাঙারি ব্যবসায়ী আব্দুর রশিদ। সংসদীয় আসনের উপনির্বাচন নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে একটু অবাক হন।
বললেন, ‘এখন আবার কিসের ভোট?’
শহরের নামাজগড় নূরানি মোড় এলাকার বাসিন্দা ৮০ বছরের এই আব্দুর রশিদ।
হাসিমুখে বলেন, ‘নির্বাচনের কিছু তো শুনিনি বাবা। সকাল ৯টায় বের হই। সারা দিন ভাঙারির মাল নিয়ে মহাজনকে দিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি যাই। ভোটের কিছু জানি না।’
বিএনপির সাত এমপির পদত্যাগের কারণে আগামী ১ ফেব্রুয়ারি বগুড়া ৪ ও ৬ আসনে উপনির্বাচনে ভোট হতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে অনেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ শুরু করেছেন।
বিএনপির দুর্গখ্যাত আসন দুটির বিভিন্ন এলাকা ঘুরে নির্বাচনের কোনো আমেজ দেখা যায়নি। শুধু অল্প কিছু পোস্টার, ব্যানার সাঁটানো আছে। সেগুলোও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের। বরং আসন দুটির অনেক ভোটার নতুন করে উপনির্বাচনের বিষয়টি জানেনই না।
প্রার্থীরা বলছেন, তারা ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। প্রতীক পেয়েই পুরোদমে মাঠে নামবেন প্রার্থীরা। আইন অনুযায়ী প্রতীক বরাদ্দের আগে প্রচারে নামা সম্ভব নয়। তবে সামাজিক মাধ্যমের বিকাশের যুগে আনুষ্ঠানিকভাবে না নামলেও আলোচনা শুরু হয়ে যায় আগেই। কিন্তু বগুড়ায় নাই সেটিও।
বগুড়া-৬ আসনে মোট মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন ৯ জন। এদের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হলেন রাগেবুল আহসান রিপু, জাতীয় পার্টির নুরুল ইসলাম ওমর, জাসদের (ইনু) ইমদাদুল হক ইমদাদ ও গণফ্রন্টের আফজাল হোসেন।
বাকি ৫ জন স্বতন্ত্র। তারা হলেন আব্দুল মান্নান, সৈয়দ কবির আহম্মেদ মিঠু, মাছুদার রহমান হেলাল, আশরাফুল হোসেন আলম ও রাকিব হোসেন।
বগুড়া-৬ আসনটি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়া পরিবারের ঘরের আসন। ১৯৭৯ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত যেসব নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, তার প্রতিটিতেই জিতেছে বিএনপি। এর মধ্যে ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত চারবার সংসদ সদস্য হন বেগম খালেদা জিয়া।
যেহেতু নির্বাচনে বিএনপি থাকছে না, যে কেউ জিতে যেতে পারেন। তবে প্রচারের দিকে এখন পর্যন্ত এগিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল মান্নান আকন্দ। তিনি সদরের বেশ কয়েকটি এলাকায় জনসংযোগ করেছেন। পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমেও সরব।
সদরের সাবগ্রাম এলাকার ব্যবসায়ী মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘ভোটের বিষয়টি এবার ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কারণ দুটি হতে পারে। হঠাৎ আসন শূন্য হওয়াটা অনেকে জানেন না। আবার বিএনপি না থাকায় নির্বাচনী আমেজ কম রয়েছে।’
গোকুল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলী রেজা তোতুল বলেন, ‘সত্যি বলতে আমরা এখনও সাংগঠনিকভাবে প্রচার কাজ শুরু করিনি।’
স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দ কবির আহম্মেদ মিঠু বগুড়া জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। তিনি ২০১৯ সালের উপনির্বাচনেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন। ওই নির্বাচনে ভোট পেয়েছিলেন ৬৩০টি।
কবির বলেন, ‘প্রার্থীদের এখনও প্রতীক দেয়া হয়নি। প্রতীক পাওয়ার পরই প্রচারণার মূল কার্যক্রম শুরু হবে। তবে আমার শ্রমিক সংগঠন ও শহরের মানুষদের সঙ্গে নিয়মিত কথা হচ্ছে।’
এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উঠে আসছে স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল মান্নান আকন্দের নাম। এর আগে বগুড়া জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং বগুড়া পৌরসভার মেয়র পদে নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হন তিনি। তবে ২০২১ সালের পৌরসভার নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোট পান ৫৬ হাজার ৯০টি।
আব্দুল মান্নান বলেন, ‘আমি কোনো দলের হয়ে নির্বাচন করতে চাই না। আমি এমপি হতে চাই জনগণের। দল থাকবে দলের জায়গায়। এই ধারণা নিয়েই আমি জনসংযোগ করছি।’
এ আসনের নৌকার প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাগেবুল আহসান রিপু জানান, ‘প্রচারণা চলছে। মঙ্গলবার জেলায় আওয়ামী লীগের দলীয় সভা রয়েছে। এ জন্য ব্যস্ততা বেশি।’
কাহালু-নন্দীগ্রাম নিয়ে বগুড়ার ৪ আসন। ১৯৮৬ সালে সীমানা পরিবর্তন করে কাহালু ও নন্দীগ্রাম দুই উপজেলা নিয়ে আসনটি গঠন করা হয়। নন্দীগ্রাম উপজেলার ৫টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা এবং কাহালু উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা রয়েছে।
বেশ কয়েকজন প্রার্থী মনোনয়নপত্র তুললেও ভোটের মাঠ এখনও শীতল। নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকায় অনেক নেতাদের নাম আলোচনায় এসেছিল। সে সময় বেশ কিছু ব্যানার বিভিন্ন স্থানে ঝোলানো হয়। এখনও সেগুলো ঝুলে আছে।
এখানে আসনে পাঁচজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন তুলেছেন। তারা হলেন গোলাম মোস্তফা, ইলিয়াস আলী, আশরাফুল হোসেন আলম, আব্দুস জব্বার প্রাং এবং কামরুল হাসান সিদ্দিকী জুয়েল।
জাসদ নেতা এ কে এম রেজাউল করিম তানসেন মহাজোটের প্রার্থী। জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন শাহীন মোস্তফা কামাল।
কাহালু পৌর এলাকার চা ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘চা খাওয়ার জন্য নানা ধরনের লোকজন আসে। দেশ-বিদেশ সব জায়গার গল্প হয়, শুনি। কিন্তু আমার বাড়ি সদর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে। সেখানে গেলে দেখবেন অনেকে জানেই না জাতীয় ভোট আবার হচ্ছে।’
কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভোটের জমজমাট ভাব আর আগের মতো নেই। শুধু দলীয় লোকজনের মধ্যে আছে। আর এই ভোট তো হঠাৎ করে হচ্ছে।’
নন্দীগ্রামের একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক সাজ্জাদুল ইসলাম বলেন, ‘ভোটের মাঠে এখনও তেমন কিছু দেখছি না। এই ভোট একটু অন্য রকম। তবে আমরা সুন্দর পরিবেশে ভোট দিতে চাই। একজন দক্ষ ব্যক্তিকে প্রতিনিধি হিসেবে দেখতে চাই।’
নন্দীগ্রামের সাবেক পৌর মেয়র কামরুল হাসান সিদ্দিকী জুয়েল স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন তুলেছেন। তিনি পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি ছিলেন। কয়েক বছর দল থেকে বহিষ্কৃত হন। জানিয়েছেন, প্রতীক বরাদ্দের পর মাঠে নামবেন।
জাতীয় পার্টির শাহীন মোস্তফা কামাল বলেন, ‘বিগত সময় দেখেছি, মানুষ তো এলাকার এমপিদের কাছেই পায় না। ইনশা আল্লাহ, আমি ভোটে জয় পেলে এলাকার সার্বিক উন্নয়ন বাস্তবায়ন করব।’
দুই আসনে মনোনয়নপত্র কিনে আলোচনায় আছেন হিরো আলম। ছবি: নিউজবাংলা
দুই আসনে মনোনয়ন তুলে ফের আলোচনা হিরো আলম
মো. আশরাফুল হোসেন আলম ওরফে হিরো আলম এবার দুটি আসন থেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন তুলেছেন।
হিরো আলম বলেন, বগুড়া-৬ আসনে তার বসবাস। এখানকার মানুষের ইচ্ছাকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। আবার বিগত ২০১৮ সালের নির্বাচনে বগুড়া-৪ আসনে প্রার্থী হয়েছিলেন।
ভোটে বিএনপির তৃণমূলের ভূমিকা কী
উপনির্বাচন নিয়ে বিএনপি কী ভাবছে, সেটি এই প্রশ্নে কিছু বলছেন না নেতা-কর্মীরা। তবে তাদের নিরুত্তাপ ভাব বলছে নির্বাচন নিয়ে মাথাব্যথা কম।
কাহালু থানা বিএনপির সভাপতি ফরিদুর রহমান ফরিদ বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে তো আমাদের কোনো ভাবনার কিছু নেই। কারণ, কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা তো নির্বাচন বর্জন করেছি। আমরাও তৃণমূল পর্যায়ে বলে দিয়েছি ভোট দিতে না যাওয়ার জন্য।’
গত বছরের ১০ ডিসেম্বর বিকেলে রাজধানীর গোলাপবাগে ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ থেকে বিএনপির দলীয় সাতজন এমপির পদত্যাগ ঘোষণা আসে। পরদিন ১১ বিএনপির ছয়জন সংসদ সদস্য স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। একজন দেশের বাইরে ছিলেন। তিনি পরে জমা দেন পদত্যাগপত্র।
এই সাত সংসদ সদস্যের মধ্যে রুমিন ফারহানা সংরক্ষিত নারী আসনের। বাকি ছয়টি আসনে হচ্ছে উপনির্বাচন।