মহানন্দার হিমশীতল পানিতে গা ভাসিয়ে থাকতে হয় আট ঘণ্টা। এর বিনিময়ে রোজগার হয় ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা।
নদীর ঠান্ডা পানিতে ডুবে ডুবে সংগ্রহ করা নুড়িপাথর বিক্রি করে যে আয় হয়, তা দিয়ে ছয় সদস্যের সংসার চলে বাংলাবান্ধা ইউনিয়নের ঝড়ুয়াপাড়া গ্রামের আব্দুল জলিলের।
ঠান্ডা পানিতে হাত-পা বাঁকা হয়ে অবশ হতে বসলে কিছু সময়ের জন্য পাড়ে উঠে গা গরম করে আবারও নামতে হয় ঠান্ডা জলে।
বাংলাবান্ধা থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার নদীপথে হাজার হাজার মানুষ তীব্র এই শীতে মহানন্দার হিমশীতল পানিতে নুড়িপাথর সংগ্রহ করে জীবনে চালাচ্ছে।
তেঁতুলিয়া উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের নদীকেন্দ্রিক লক্ষাধিক মানুষের জীবন চলে এই পাথর সংগ্রহ করেই।
ভারত থেকে বয়ে আসা এই মহানন্দা বাংলাদেশের তেঁতুলিয়া দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আবার ঢুকে পড়ে ভারতে। বাংলাদেশি অংশের এই নদীপথে সারা বছরেই পাথর সংগ্রহ চলে।
কিন্তু দুর্ভোগ বাড়ে শীত মৌসুমে। অনেকে ঠান্ডায় কাজ করতে না পেরে বেকার হয়ে অনাহারে দিন কাটায়।
১৫ থেকে ২০ জনের গ্রুপ করে নদীতে নেমে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যে পাথর সংগ্রহ হয়, তা মহাজনের কাছে বিক্রি করে জনপ্রতি পাওয়া যায় ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা। আর এ টাকা দিয়েই চলে একেকজনের সংসার।
হিমালয়ের খুব কাছে অবস্থান হবার কারণে শীতের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি পঞ্চগড়ে। প্রতিবছরেই এই জেলায় তাপমাত্রা সর্বনিম্ন পর্যায়ে এসে দাঁড়ায় । জনদুর্ভোগ বেড়ে যায় সীমাহীন।
এদিকে তীব্র শীতে নানা রোগে আক্রান্ত হয় সব বয়সের মানুষ। বিশেষ করে শিশুরা আক্রান্ত হয় ডায়েরিয়াসহ নানা শীতজনিত রোগে।
এ বছর ডিসেম্বর থেকেই অব্যাহতভাবে তাপমাত্রা এক অঙ্কে এসে দাঁড়িয়েছে, যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে।
উত্তরের সীমান্ত জনপদ পঞ্চগড়ে শীতের তাণ্ডব দেশের সব রেকর্ড ভেঙেছে। ঘন কুয়াশা এবং পাহাড় থেকে নেমে আসা হিমেল হাওয়া বইতে থাকায় সীমান্ত এই জনপদের মানুষের জীবনযাত্রাকে স্থবির করে ফেলেছে।
অব্যাহত শীতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা প্রায় অচল হতে বসেছে। বিশেষ করে ছিন্নমূল এবং খেটে খাওয়া মানুষজন পড়েছে বিপাকে।
একদিকে কর্মহীন হয়ে পড়া, অপরদিকে শীতজনিত বিভিন্ন রোগবালাই মানুষকে অসহায় করে ফেলেছে। বিশেষ করে শিশু এবং বয়স্ক মানুষদের দুর্ভোগ চরমে।
সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত শিশু ও বয়স্কদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পঞ্চগড় শহরের অটোচালক আলমগীর হোসেন জানায়, অটোরিকশা চালিয়ে সে সংসার চালায়। গত ১৫ দিন ধরে ঠান্ডার কারণে ভাড়া মিলছে না।
হরেক মালের ব্যবসায়ী শরিফুল জানায়, শীতের মধ্যেই সাইকেলে করে মালামাল নিয়ে গ্রামে যেতে হচ্ছে কিন্ত তীব্র শীত এবং ঘন কুয়াশার কারণে বেচাকেনা অনেক কমে গেছে।
পঞ্চগড় সদর আধুনিক হাসপাতালের শিশুবিশেষজ্ঞ মনোয়ারুল ইসলাম জানায়, রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে শিশু ডায়রিয়া ও শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তাদের চিকিৎসা এবং সুরক্ষিত রাখার পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে।
তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা বলছেন, পুরো ডিসেম্বর ধরে তেঁতুলিয়ায় যে তাপমাত্রা বিরাজ করছে, তা দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে। জানুয়ারিতে একাধিক শৈতপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তখন তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রিতে নেমে যেতে পারে।
পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক জহুরুল ইসলাম জানান, প্রতিবছর শীতপ্রবণ এই এলাকার মানুষের কথা ভেবে সরকারিভাবে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সুরক্ষিত রাখা হয়। এ বছর একই সঙ্গে করোনা এবং শীত মোকাবিলা করতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তুতি রাখা হয়েছে।
ইতিমধ্যে সরকারিভাবে যে পরিমাণ শীতবস্ত্র পাওয়া গেছে, তা শীতার্ত মানুষের মাঝে বিলি করা হয়েছে। নতুন করে বরাদ্দ চেয়ে বার্তা দেয়া হয়েছে।
তেঁতুলিয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কাজী আনিস জানান, পাহাড়ি হিমেল হাওয়া বইতে থাকায় কর্মজীবী মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। তাদের শীতে সুরক্ষার পাশাপাশি অভাবি মানুষের কাছে খাদ্য সাহায্য পাঠানো প্রয়োজন। সে জন্য দরকার সরকারের হস্তক্ষেপ ।