ময়মনসিংহের ত্রিশালে ট্রাকচাপায় মায়ের পেট ফেটে জন্ম নেয়া শিশু ফাতেমা সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত রাজধানীর আজিমপুরে ছোটমণি নিবাসে একটু একটু করে বড় হচ্ছে।
দাদা-দাদী মাঝে-মধ্যে দেখতে গেলে কখনো হাসির ঝিলিক আবার কখনো মুখ গম্ভীর করে শিশুটি। সবসময় কাছে রাখতে শিশুটিকে বাড়ি নিয়ে যাবেন বলে জানিয়েছেন দাদা মোস্তাফিজুর রহমান বাবলু।
উপজেলার রায়মনি এলাকার জাহাঙ্গীর আলম গত বছরের ১৬ জুলাই অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষা করাতে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন।
বিকেল সোয়া তিনটার দিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ত্রিশাল কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় সড়ক পারাপারের জন্য সড়কের পাশে দাড়িয়ে থাকা অবস্থায় ট্রাকচাপায় প্রাণ হারান জাহাঙ্গীর, তার স্ত্রী রত্না বেগম ও তাদের মেয়ে সানজিদা আক্তার। মৃত্যুর আগে রত্নার পেট ফেটে ভূমিষ্ঠ হয় নবজাতক। পরে স্থানীয়রা নবজাতকটিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়।
সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও উন্নত চিকিৎসার জন্য নবজাতকটিকে ময়মনসিংহ সদরের সিবিএমসি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. কামরুজ্জামানের তত্ত্বাবধানে শিশুটি নগরীর লাবীব হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল। সেখানে কয়েক দিন চিকিৎসা দেয়ার পর ১৯ জুলাই ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
পরে সম্পূর্ণ সুস্থ হলে ২৯ জুলাই স্বজনদের সম্মতিতে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে শিশুটিকে রাজধানীর আজিমপুরে ছোটমণি নিবাসে পাঠায় জেলা প্রশাসক।
১৯৯৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান ফাতেমার দাদা মোস্তাফিজুর রহমান বাবলুর এক ভাই। ২০০৪ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩ বছর বয়সী এক ছেলেকে হারিয়েছেন তিনি। তাঁর আপন তিন মামাও মারা গেছেন সড়ক দুর্ঘটনায়। এ বছর হারালেন এক ছেলে, ছেলের বউ ও এক নাতনিকে।
মোস্তাফিজুর রহমান বাবলু বলেন, ‘মঙ্গলবার স্ত্রী এবং নাতনি জান্নাতকে নিয়ে শিশুটিকে দেখতে গিয়েছিলাম। সে এখন কোলে চড়তে চায়। হাতের স্পর্শ খুঁজতে থাকে। কখনও মুখে হাসির ঝিলিক আবার কখনও মুখ গম্ভীর করে রাখে। তার মুখ বেশিদিন না দেখে বাড়িতে থাকতে পারিনা। তাই মাসে এক দুইবার ছোটমণি নিবাসে চলে আসি।
‘কিন্তু আবারও দুর্ঘটনার আশংকায় সড়কে বের হলেই এখন আঁতকে উঠি। তবুও নাতনির মুখ দেখতে বাধ্য হয়ে আসতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনায় ছেলে, ছেলের বউ ও নাতনি মারা যাওয়া এবং আরেক নাতনির জন্ম হওয়ায় দিশাহারা হয়ে গিয়েছিলাম। আমিই জেলা প্রশাসককে বলেছিলাম, ফাতেমা ভালো থাকবে, এমন একটি জায়গায় রাখার জন্য।
‘এখন ফাতেমা ভালো থাকলেও বৃদ্ধ বয়সে তাকে দেখতে আসা আমার জন্য অনেক কষ্টের। সে একটু বড় হওয়ায় দ্রুত বাড়ি নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ আমি সরকারের প্রতিবন্ধী ভাতা পাই। এ ছাড়া বাড়ির পাশে একটি চায়ের দোকান চালিয়ে যে টাকা পাই সেগুলোসহ শিশুটির অ্যাকাউন্টে থাকা কিছু কিছু টাকা খরচ করে সংসার চালানো যাবে।’
দত্তক দেয়া হবে কিনা এমন প্রশ্নে মোস্তাফিজুর রহমান বাবলু বলেন, ‘শিশুটিকে যিনি ভালোভাবে লালন-পালন করে উচ্চ শিক্ষিত বানাবে তার কাছেই দত্তক দিব। তবে সেক্ষেত্রে ওই লোকের আমাদের সাথে আত্নীয় করতে হবে, আমাকে বাবা অথবা শশুর হিসেবে মনে করতে হবে। যেনো আমাদের মনে হয়, শিশুটি তার বাবা-মায়ের কাছেই আছে। ফাতেমার বোন জান্নাত ও ভাই এবাদুল্লাহকে নিজের সন্তান মনে করে খরচ বহন করতে হবে। তাহলেই নিশ্চিন্তে দত্তক দেয়া যাবে।’
ছোটমণি নিবাসের উপতত্ত্বাবধায়ক জুবলী বেগম রানু বলেন, ‘এ নিবাসে মা-বাবার পরিচয়হীন শূন্য থেকে সাত বছর বয়সী পরিত্যক্ত বা পাচার থেকে উদ্ধার হওয়া, বাবা ও মায়ের আদালতে মামলা চলছে-এমন শিশুদের রাখা হয়। কিন্তু ময়ের পেট ফেটে জন্ম নেয়া শিশুটির সব পরিচয় থাকার পরও থাকা-খাওয়া, চিকিৎসার কথা চিন্তা করে তাকে এখানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জেলা প্রশাসন। বর্তমানে নিবাসে ফাতেমাসহ ২৬ শিশু রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সড়কে জন্মের সময় শিশুটি হাতে ব্যথা পেয়েছিল। গালে আঘাতের চিহ্ন ছিল। তবে সে এখন পরিপূর্ণ সুস্থ। বর্তমানে ওর ওজন ৪ কেজি ৫০০ গ্রাম। তাকেসহ অন্য শিশুদের যত্ন সহকারে বড় করা হচ্ছে। তবে আমাদের কাছে থাকার চাইতে ভালো মানুষের কাছে দত্তক দিতে পারলে আরও ভালো থাকবে।’
ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মো. মোস্তাফিজার রহমান বলেন, ‘শিশুটির পরিবারের অস্বচ্ছলতার কারণে সবসময় ভালো রাখতে ছোটমণি নিবাসে পাঠানো হয়েছিল। আমরাও সবসময় খোঁজখবর নিয়েছি। সে এখন খুব ভালো আছে।’