উত্তরের দারিদ্র্যপীড়িত জেলা কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলায় ভালনারেবল ওমেন বেনিফিট (ভিডব্লিউবি) প্রকল্পের তালিকা তৈরিতে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে। তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য জনপ্রতি আদায় করা হচ্ছে ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা। এভাবে প্রায় দুই কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সংঘবদ্ধ একটি চক্র।
ভিজিডির নতুন নামে চালু হওয়া এ প্রকল্পে এমন কাণ্ডে সরকারের মহতী এ প্রকল্পের সুফল থেকে হতদরিদ্ররা বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তালিকা থেকে হচ্ছেন অস্বচ্ছল, বিধবা, প্রতিবন্ধীসহ হতদরিদ্ররা।
অভিযোগ উঠেছে, কুড়িগ্রাম-৪ (চিলমারী-রৌমারী-রাজিবপুর) আসনের সংসদ সদস্য এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের নির্দেশনায়ই ভিডব্লিউবি কার্ড বিতরণ নিয়ে এমন তুঘলকি কাণ্ড ঘটানো হয়েছে।
রৌমারী উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর পরিচালিত ভিডব্লিউবি ২০২৩-২৪ প্রকল্পের আওতায় উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে মোট তিন হাজার ২৫৩টি কার্ড বরাদ্দ করা হয়। এর বিপরীতে অনলাইনে আবেদন পড়ে ১২ হাজার ৪০০টি।
নীতিমালা অনুযায়ী, ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত মহিলা সদস্যের সভাপতিত্বে তৃণমূল পর্যায়ে কমিটির মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে উপকারভোগীদের তালিকা করতে হবে। পরে ইউনিয়ন কমিটি সব তালিকা সমন্বয় করে উপজেলা কমিটিতে জমা দেবে। অসচ্ছল, বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত নারী ও প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকারের কথাও বলা আছে নীতিমালায়।
অভিযোগ উঠেছে, নীতিমালার তোয়াক্কা না করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সরকার দলীয় নেতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে ভিডব্লিউবি কার্ড বণ্টন করা হয়েছে। এর মধ্যে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ৬; দুই ভাইস চেয়ারম্যান ৬; প্রতিমন্ত্রী, মুক্তিযোদ্ধা, উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও স্থানীয় প্রেসক্লাব ২৩ এবং ছয়টি ইউনিয়নে ৬৫ শতাংশ কার্ড ভাগাভাগি করে নিয়েছেন।
কার্ড ভাগাভাগি পর্ব শেষে এখন চলছে কার্ড বিক্রির প্রতিযোগিতা। কার্ডপ্রতি নেয়া হচ্ছে পাঁচ থেকে আট হাজার টাকা। এ নিয়ে উপজেলা জুড়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে।
অনিয়ম-স্বজনপ্রীতিতে পিছিয়ে নেই ৬৫ শতাংশ কার্ড বরাদ্দ পাওয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানরাও। তারা ইচ্ছেমাফিক সদস্যদের মাঝে ভাগ করে দেন এসব কার্ড। এভাবে কাগজ-কলমে ক্ষমতা দিলেও বাস্তবে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে সংরক্ষিত নারী সদস্যদের।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, টাকার অভাবে ও প্রচারের ঘাটতিতে হতদরিদ্রদের অনেকেই অনলাইনে আবেদন করতে পারেননি। আর যারা আবেদন করেছেন তাদেরকেও বাছাইয়ের জন্য ডাকা হয়নি।রৌমারী সদর ইউনিয়নের মণ্ডলপাড়া গ্রামের কর্মক্ষমহীন মোতালেবের স্ত্রী মাকছুদা খাতুন বলেন, ‘স্বামী অসুস্থ। তিন ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে খুব কষ্টে আছি। চেয়ারম্যান, মেম্বার ও নেতাদের কাছে গিয়েছিলাম একটি কার্ডের জন্য। তারা বলে দিয়েছেন, টাকা ছাড়া কার্ড মিলবে না। টাকা দিতে না পেরে বাধ্য হয়ে ফেরত আসতে হয়েছে।’
শৌলমারী ইউনিয়নের বেহুলারচর গ্রামের আব্দুল গফুরের বিধবা মেয়ে মমিরন নেছা অভিযোগ করে বলেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ার পর সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় দুই সন্তানকে নিয়ে বাবার বাড়িতে ঠাঁই নিয়ে আছি। মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। সরকার আমাদের মতো অসহায় মানুষের জন্য হাজার হাজার নাম বরাদ্দ দিলেও চেয়ারম্যান-মেম্বাররা সেগুলো টাকার বিনিময়ে স্বচ্ছল ও ধনী মানুষের কাছে বিক্রি করেছে।’
দাঁতভাঙ্গা ইউনিয়নের বালুর গ্রামের প্রতিবন্ধী সাদিকুল ইসলামের স্ত্রী হাছনা বানু জানান, তার স্বামী একজন প্রতিবন্ধী। আয়-রোজগার নেই। খেয়ে-না খেয়ে সন্তানদের নিয়ে দিন কাটছে। ভিডব্লিউবি কার্ডের জন্য মেম্বার-চেয়ারম্যানের কাছে ঘুরেও পাত্তা পাননি। দালালের মাধ্যমে তার কাছে ৮ হাজার টাকা চাওয়া হয়। সেই টাকা দিতে না পারায় তালিকায় তার নাম ওঠেনি।
বন্দবেড় ইউনিয়নের সংরক্ষিত ১ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য রুবি খাতুন অভিযোগ করে বলেন, ‘নীতিমালা অনুযায়ী ভাগের কার্ড চাইতে গেলে ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের আমাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেন। এ ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা নেই বলেও জানান চেয়ারম্যান।
‘নীতিমালা অনুযায়ী একশ’ নামের তালিকা করার এখতিয়ার থাকলেও আমাকে ২০টি নাম তালিকাভুক্ত করার সুযোগ দেয়া হয়েছে।’
যাদুরচর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত সদস্য রহিতন নেছা বলেন, ‘ভাগে ২০টি নাম পেয়েছি। তা নিজের দরিদ্র আত্মীয়-স্বজনদের নামে দেয়া হয়েছে। তবে কার্ডের বিনিময়ে আমি কোনো টাকাপয়সা নেইনি।’
স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার শামছুল আলম এ বিষয়ে বলেন, ‘যাদের ঘরে খাবার আছে এবং যারা টাকা দিতে পারছেন তাদের নামই কার্ডের জন্য তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের নামে কোনো কার্ড বরাদ্দ দেয়া হয়েছে কিনা সেটা আমার জানা নেই।’
রৌমারী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ইমান আলী বলেন, ‘ভিডব্লিউবি কার্ড বণ্টন করার বিষয়টি আগে থেকে প্রচলিত হয়ে আসছে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা এই কার্ড বণ্টন করে থাকেন। এটা কোনো সরকারি নিয়মনীতির মধ্যে পড়ে না। আমি নতুন এসেছি। পরে প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশের এভাবে কার্ড বণ্টন করা হয়েছে।’
রৌমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু হোরায়রা বলেন, ‘৪২২টি নাম ভাগে পাওয়া গেছে। তা দলের সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মাঝে ভাগ করে দেয়া হয়েছে।’
বন্দবেড় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের বলেন, ‘সংরক্ষিত সদস্যরা ভিডব্লিউবি তালিকা যাচাই-বাছাই কমিটির প্রধান হবেন এমন নিয়ম নেই। জনসংখ্যার অনুপাতে নাম ভাগ করে দেয়া হয়েছে।’টাকা নেয়ার কথা অস্বীকার করে রৌমারী সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘যাদের নাম তালিকায় আসেনি তারাই এমন অভিযোগ করছেন। ইউনিয়নে যে নাম ভাগে পাওয়া গেছে, তা আমরা ১৩ জন সদস্য মিলে ভাগাভাগি করে নিয়েছি।’
রৌমারী উপজেলা আওয়ামী কৃষক লীগের সভাপতি মতিয়ার রহমান চিশতী বলেন, ‘ভিডব্লিউবি কার্ডের জন্য নাম দিতে টাকা নেয়ার বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। যাচাই-বাছাই ছাড়া টাকায়ই যদি নাম তালিকায় ওঠে তাহলে অনলাইনে আবেদনের নামে গরিবের সঙ্গে তামাশা করা হলো কেন?’রৌমারী প্রেসক্লাব সভাপতি সুজাউল ইসলাম সুজা অভিযোগ করে বলেন, প্রেসক্লাবের নাম ভাঙিয়ে একটি চক্র ভিডব্লিউবির কার্ড ভাগভাগি করে নিয়েছে। সুষ্ঠু তদন্ত করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাচ্ছি আমরা।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইউপি মেম্বার বলেন, ‘অন্যান্য উপজেলা থেকে রৌমারী উপজেলা আলাদা। এখানে টাকা লেনদেন ওপেন ঘটনা। টাকা ছাড়া কিছুই মেলে না। এখানকার উপজেলা চেয়ারম্যানসহ উপজেলার সবাই জানে টাকা ছাড়া কোনো নাম তালিকাভুক্ত হয় না।’
টাকার অংকের বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘৬ হাজার, ৭ হাজার ও ৯ হাজার টাকা করে নেয়। যার কাছ থেকে যেমন নিতে পারে। প্রতিমন্ত্রীর ভাগের কার্ড মোস্তাফিজুর রহমান রবিন ও মশিউর রহমান বিতরণ করেন। তারা দুজনই প্রতিমন্ত্রীর আপন চাচাতো ভাই। তারা রৌমারী উপজেলায় সব কর্মকাণ্ডে প্রতিমন্ত্রীর প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন।’
এ বিষয়ে মোস্তাফিজুর রহমান রবিন বলেন, ‘আমি পারিবারিক কাজে রৌমারীর বাইরে ছিলাম। কার্ড বিতরণ আমি করিনি। সম্ভবত মশিউর করেছে।’
রৌমারী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ইমান আলী বলেন, ‘ভিডব্লিউবি কার্ড বণ্টন করার বিষয়টি আগে থেকে প্রচলিত হয়ে আসছে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা এই কার্ড বণ্টন করে থাকেন। এটা কোনো সরকারি নিয়মনীতির মধ্যে পড়ে না। আমি নতুন এসেছি। পরে প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশের এভাবে কার্ড বণ্টন করা হয়েছে।’
ভিডব্লিউবি প্রকল্পের সদস্য সচিব ও রৌমারী উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা জেবুন নেছা বলেন, ‘কার্ড ভাগাভাগির বিষয়টি আমার জানা নেই। নিয়ম অনুযায়ী নামের তালিকা করা হয়েছে।’
তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের বিষয়টি সঠিকভাবে মনিটরিং করা হয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জনবল সঙ্কটের কারণে এতো নাম মনিটরিং করা সম্ভব হয়নি। টাকা নেয়ার বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
ভিডব্লিউবি প্রকল্পের কার্ড বিতরণ নিয়ে এমন অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি।
গত পাঁচ দিনে তার মোবাইল ফোনে বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। সাংবাদিক পরিচয় উল্লেখ করে খুদে বার্তাও পাঠানো হয়। কিন্তু তিনি সাড়া দেননি।
সচিবালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। এরপর প্রতিমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা রাশেদুল ইসলামের মাধ্যমে যোগাযোগ করেও প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
মন্ত্রণালয়ের তথ্য কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য চাওয়া হলেও মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত তা পাওয়া যায়নি।