বিশ্বজুড়ে বাড়ছে কৃষিপণ্যের চাহিদা। সম্প্রসারিত হচ্ছে নিরাপদ খাদ্যের বাজার। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে এবার ইউরোপের বাজার ধরতে প্রস্তুত হচ্ছে পদ্মাপারের জেলা শরীয়তপুরের কৃষকরা।
নতুন বছরের শুরুতেই দেশের গণ্ডি পেরিয়ে যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপে যাচ্ছে পদ্মাপারের জেলা শরীয়তপুরের বিষমুক্ত সবজি।
২ জানুয়ারি প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে জাজিরার লাউ, করলা, কচু, শিম আর কাঁচা মরিচ রপ্তানি নিশ্চিত করেছে রপ্তানিকারকরা।
পদ্মা সেতুর কারণে যোগাযোগ সহজ হওয়ায় এখানকার সবজি ক্রয়ে আগ্রহ বেড়েছে রপ্তানিকারকদের। রপ্তানি কার্যক্রম চালুর কারণে সবজির ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হওয়ায় নিজেদের ভাগ্য বদলের স্বপ্ন বুনছেন প্রান্তিক কৃষকরা।
রপ্তানিনির্ভর মানসম্মত সবজি উৎপাদনে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করেছে কৃষক, কৃষি বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসন। কৃষকদের প্রশিক্ষিত করতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও সভা করছে তারা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, শরীয়তপুরে ৮৫ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ করা হয় বিভিন্ন কৃষিপণ্য। যার মধ্যে পদ্মা সেতু ঘেঁষা জাজিরায় আবাদ করা হয় ১৭ হাজার ৮৭৬ হেক্টর জমি।
উপজেলার অনাবাদি কৃষিজমিকেও আবাদের আওতায় আনতে কাজ শুরু করেছে স্থানীয় প্রশাসন ও কৃষি বিভাগ।
গত ২৬ জুন পদ্মা সেতুতে যানবাহন চলাচল শুরুর কারণে উন্নত হয়েছে এই অঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থা। তাই রাজধানী থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরের জাজিরার সবজির দিকে চোখ রপ্তানিকারকদের।
কোনো মধ্যস্বত্বভোগী না থাকায় জাজিরার মিরাশার চাষি বাজার থেকে সরাসরি কৃষকের সবজি ক্রয় করার সুযোগ পাচ্ছেন রপ্তানিকারক ও ব্যবসায়ীরা। প্রাথমিকভাবে এখানকার লাউ, করলা, শিম, কচু আর কাঁচা মরিচ রপ্তানির হবে যুক্তরাজ্য, সুইডেন, সুইজারল্যান্ডসহ ইউরোপের বাজারে।
জাজিরার মুলনা এলাকার সিরাজ মাদবর বলেন, ‘এ বছর চাষ করা ১৫টি কচু মিরাশা বাজারে উঠাইছিলাম। পাইকাররা কচুর দাম ৩০-৩৫ টাকার বেশি কয় না। তাই মন খারাপ কইরা কচু বাড়ি লইয়া গেছিলাম। অহন দেখতাছি বিদেশে পাঠানোর জন্য কচু খোঁজতাছে ঢাকা থেকে আহা ব্যবসায়ীরা। হেগো লগে কতা কইয়া আমার কচু ১০০ টাকা কইরা বিক্রি করলাম। তবে সব কচু হেরা নেয় নাই। বাইছা ভালো কচুগুলা কিনা নিছে।’
মিরাশা চাষি বাজারের সভাপতি জলিল মাদবর বলেন, ‘দেশি বাজার থেকে কৃষক অনেক সময় ন্যায্যমূল্য পায় না। লোকসানে সবজি বিক্রি করতে হয়। আবার অনেক সময় সবজির ক্রেতা পাওয়া যায় না। তখন কৃষকের লোকসান হয়। বিদেশে রপ্তানির যে কার্যক্রম আজ থেকে শুরু হলো, তা অব্যাহত থাকলে কৃষকের পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে দেশও লাভবান হবে।’
সবজি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ট্রেড লিংকের প্রোপ্রাইটর রাজিয়া সুলতানা জানান, ‘পদ্মা সেতু হওয়ায় এই অঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগব্যবস্থা অনেক সহজ হয়েছে। তবে বিষমুক্ত নির্ধারিত মানসম্মত সবজি উৎপাদন করতে হবে। সবজির মান ঠিক রাখতে কৃষকদের প্রশিক্ষিত করতে হবে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে এমন উদ্যোগের কথা শুনেছি। এটা নিশ্চিত করা গেলে এখান থেকে নিয়মিত সবজি রপ্তানি সম্ভব।’
আরেক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএইচ ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘পরীক্ষামূলক রপ্তানির জন্য আজ মিরাশা বাজার থেকে কিছু কচু ক্রয় করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও কিছু সবজি ক্রয় করে তা ঢাকায় নিয়ে প্রসেসিং করে আজ যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপে রপ্তানি করা হবে।’
জাজিরা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জামাল হোসেন বলেন, ‘কৃষকদের উৎপাদিত ফসল বিদেশে রপ্তানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে কৃষি বিভাগ ও জেলা প্রশাসনের সহায়তায় কৃষকদের সচেতন করতে সভা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রপ্তানি প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় বিদেশে সবজি রপ্তানির একটি বড় বাজার হবে জাজিরা।’
শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মো. পারভেজ হাসান বলেন, ‘উচ্চমূল্যের আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের সবজি বিপণনে সরকারি-বেসরকারি সংস্থার সম্পৃক্ততা জরুরি। তাই সবজি রপ্তানি নিশ্চিত করতে কৃষক, আমদানিকারক ব্যবসায়ী, কৃষি বিভাগ ও জেলা প্রশাসন সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
‘পদ্মা সেতু এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে বিশাল পরিবর্তন এনেছে। পদ্মা সেতুকে কাজে লাগিয়ে এই জেলার কৃষিকে এগিয়ে নিতে রপ্তানিকারদের সঙ্গে কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তাদের সভার আয়োজন করা হয়েছে। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুযায়ী সবজি উৎপাদনে কৃষকদের বিশেষভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কৃষক, ব্যবসায়ী, কৃষি বিভাগ ও জেলা প্রশাসকের সমন্বিত উদ্যোগের ফলে শিগগিরই রপ্তানিকারকদের কাছে জাজিরা জনপ্রিয় বাজারে পরিণত হবে।’