ক্রয় বা উৎপাদন খরচের সঙ্গে মিল রেখেই বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম দিতে হবে বলে ব্যবসায়ীদের বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলেছেন, ভর্তুকির টাকা জনগণের ভাগ থেকে গেলেও এর সীমা আছে। ব্যবসায়ীদেরকে এই বিষয়টি বুঝতে হবে।
বিদ্যুতের পাইকারি দাম প্রায় ২০ শতাংশ বাড়ানোর পর খুচরা পর্যায়েও দাম বাড়ানোর ইঙ্গিতের মধ্যে রোববার রাজধানীর পূর্বাচলে বাণিজ্য মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যে প্রসঙ্গটি তোলেন তিনি।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে টালমাটাল বিশ্ব পরিস্থিতিতে জ্বালানির আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশে দেশেই গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। তবে কঠিন এই সময়ে এই দর বৃদ্ধি চলমান মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে বলে আশঙ্কা করে ব্যবসায়ীরা সরকারকে এই সময়ে এই সিদ্ধান্ত না নেয়ার অনুরোধ করছেন।
এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিদ্যুৎ আর গ্যাস যদি নিরবিচ্ছিন্ন চান তাহলে এগুলো ক্রয় করতে বা উৎপাদন করতে যে খরচ হবে সেই খরচের দামটা তো দিতে হবে।’
কত আর ভর্তুকি দেয়া যাবে?- এই প্রশ্ন রেখে ‘ভর্তুকি তো জনগণের টাকায় এত দেয়াও যায় না। ব্যবসায়ী বা শিল্পপতিদের এ দিকটাতে একটু নজর দিতে হবে।’
বিদেশে রপ্তানি বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশে বাজার সৃষ্টির তাগিদও দেন সরকার প্রধান। তিনি বলেন, ‘আমরা রপ্তানি যেমন করব আবার নিজের দেশের বাজারও যেন সৃষ্টি হয়, মানুষের ক্রয় ক্ষমতাও যেন বাড়ে সেদিকেও আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। তাহলে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিগুলো আরও কার্যকর হবে, উৎপাদন বাড়বে, সে ব্যবস্থাটা আমরা নিয়েছি।
‘আজকে আমরা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি। এই মর্যাদা কার্যকর করার জন্য আমরা ইতিমধ্যে কমিটি করে কোন খাতে কী কী করণীয়, সেগুলো সুনির্দিষ্ট করে আমরা পদক্ষেপ নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।’
বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের তাগিদ
বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সবাইকে সাশ্রয়ী হওয়ার তাগিদও দেন সরকারপ্রধান। তিনি বলেন, ‘মাঝখানে আমাদের সমস্যা হয়েছিল। সারা বিশ্বে ইউক্রেন যুদ্ধ আর স্যাংশন-পাল্টা স্যাংশনের কারণে গ্যাস ক্রয় করতে হয় এলএনজি, ভোজ্য তেল, জ্বালানি তেল, গম, ভুট্টা, চিনি…প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়ে গেছে, পরিবহনের খরচও বেড়ে গেছে।
‘এ কারণে আমরা বাধ্য হয়েছিলাম কিছুদিনের জন্য লোডশেডিং দিতে। এখন এটা কমে গেছে। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রায় আট শ মেগাওয়াট বিদ্যুত এখন ঢাকার গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। এরপরও আমি বলব, যে যা বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন, সবাই একটু সাশ্রয় করবেন। এতে সবাই ভালো থাকবেন।’
ভারত থেকে পাইপলাইনে জ্বালানি তেল আমদানির কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আগে শুধু জাহাজে করে যেত। এখন আমরা আসামের লুমানিঘর থেকে পাইপলাইনে ডিজেল আ্মদানি করছি। এটা আমাদের উত্তরবঙ্গের কাজে লাগবে।’
অর্থনৈতিক কূটনীতিতে জোর
অর্থনীতিকে চাঙা রাখতে বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোকে অর্থনৈতিক কূটনীতিতে জোর দেয়ার তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘কোভিডের পর আসলো ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। স্যংশন পাল্টা স্যাংশন, যার কারণে বিশ্বব্যাপী মন্দা। অনেক উন্নত দেশ হিমশিম খাচ্ছে। যার কারণে নিজেদের মন্দার দেশ হিসেবে ঘোষণা করছে। আমরা কিন্তু বাংলাদেশ, এখনও সেই পর্যায়ে যাই নাই। আমরা কিন্তু আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সক্ষম হয়েছি।
‘সকল দূতাবাসকে আমরা নির্দেশ দিয়েছি, এখনকার ডিপ্লোমেসি পলিটিক্যাল ডিপ্লোমেসি না ইকোনোমিক ডিপ্লোমেসি। অর্থাৎ প্রত্যেকটা দূতাবাস ব্যবসা বাণিজ্য রপ্তানি, কোন দেশে কোন পণ্যের চাহিদা বেশি, বা আমরা কী রপ্তানি করতে পারি, কোথা থেকে আমরা বিনিয়োগ পেতে পারি, সে দিকে দৃষ্টি দিতে আমরা নির্দেশ দিয়েছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন এলাকায় গিয়েছি। সেখানে বাংলাদেশের দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত যারা তাদের ডেকে সেভাবেই ব্রিফ করেছি, বলেছি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও বলা হয়েছে, প্রত্যেক দূতাবাস সে চেষ্টা করবে। কোন দেশে কোন পণ্যের চাহিদা রয়েছে, সেটা আমরা আমাদের দেশে উৎপাদন করব এবং রপ্তানি করব। এভাবেই আমরা আমাদের বাণিজ্য বৃদ্ধি করব।’
পণ্য উৎপাদনে বৈচিত্র্যের তাগিদ
রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনারও তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, কিছু পণ্যের উপর আমরা খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। এটাকে বহুমুখীকরণ করার কথা আমি বার বার বলেছি, এখনও বলছি। যত বেশি আমরা বহুমুখীকরণ করতে পারব, আর যত বেশি নতুন বাজার পাব, তত বেশি পণ্য রপ্তানি করতে পারব। আর বাণিজ্য মানেই লক্ষ্মী। এ কথাটা আদিকাল থেকেই শুনে আসছি। এভাবেই আমাদের চিন্তা করতে হবে।’
সেবা খাতের বিকাশেরও তাগিদ দেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে অনেক তরুণরা অনেক শক্তিশালী। তাদের যদি প্রয়োজন মতো প্রশিক্ষণ দিয়ে আমরা তৈরি করতে পারি, তাহলে সেবা খাতে অনেক কাজ পাব, দেশে বিদেশে অনেক কাজ আমরা করতে পারব।’
এক শটা অর্থনৈতিক অঞ্চল করার বিষয়টি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অনেকগুলোর কাজ আমরা শুরু করে দিয়েছি।’
এই অঞ্চলগুলোতে ফাইভ জি চালু করার কথাও ঘোষণা করেন তিনি। সেই সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি এবং প্রযুক্তিনির্ভর সেবায় গুরুত্ব দেয়ার তাগিদ দিয়েছেন তিনি। গত বছরে এই খাতে রপ্তানি আয় ৯ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে বলেও জানান তিনি।