যানজটে বিপর্যস্ত রাজধানীবাসীকে মুক্তি দিতে ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকা মহানগর ও সংলগ্ন অঞ্চলে মোট ছয়টি মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
এর মধ্যে এমআরটি-৬ এর উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১.৭৩ কিলোমিটার অংশ খুলছে বুধবার। তবে এই রুটটির মোট দৈর্ঘ্য ২১.২৬ কিলোমিটার। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষ হলে উত্তরা থেকে সরাসরি পৌঁছানো যাবে কমলাপুর।
এই প্রকল্পের বাইরে আরও পাঁচটি মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াও চলছে। এ জন্য ২০১৩ সালের ৩ জুন গঠিত হয় ঢাকা মাস ট্রানজিট (এমআরটি) কোম্পানি লিমিটেড।
‘বাঁচবে সময়, বাঁচবে পরিবেশ, যানজট কমাবে মেট্রোরেল’ শ্লোগানে যাত্রা করা এই কোম্পানি ইতোমধ্যে এমআরটি লাইন-১ (বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর) এবং এমআরটি লাইন-৫ নর্দান রুটের (হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা) কাজও অনেকটা গুছিয়ে এনেছে। এমআরটি লাইন-৫ এর সাউদার্ন রুটও রয়েছে। এছাড়া এমআরটি-২ এবং এমআরটি-৪ রয়েছে পরিকল্পনার পর্যায়ে।
এমআরটি-১
২৬.৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এমআরটি-১ এর রুট হলো হযরত শাহজালাল (রঃ) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে খিলক্ষেত, কুড়িল, যমুনা ফিউচার পার্ক, বাড্ডা, রামপুরা, মালিবাগ, রাজারবাগ, কমলাপুর এবং কুড়িল থেকে কাঞ্চন সেতুর পশ্চিম পাশ পর্যন্ত।
এর মধ্যে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১৬.৪ কিলোমিটার হবে পাতাল রেল আর কুড়িল থেকে কাঞ্চন সেতু পর্যন্ত ১০.২ কিলোমিটার হবে উড়াল রেল।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ব্যয়ে এমআরটি-১ প্রকল্পটির ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা। এমআরটি লাইন-১ চালু হলে দৈনিক আট লাখ যাত্রী পরিবহন সক্ষমতা তৈরি হবে।
প্রকল্পের নির্মাণ কাজ তদারকির জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়ে গেছে। এছাড়া এমআরটি লাইন-১-এর পিতলগঞ্জ ডিপোর ভূমি উন্নয়নের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও চুক্তি হয়েছে।
এমআরটি-১ প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাপানের বহুজাতিক কনসোর্টিয়ামের নিপ্পন কোআই করপোরেশন কোম্পানি জেভির সঙ্গে গত ২৩ অক্টোবর চুক্তি সই হয়। এ কনসোর্টিয়ামে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে দেশি-বিদেশি আটটি প্রতিষ্ঠান। চুক্তিতে সই করেন ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক এবং নিপ্পন কোয়াই কোম্পানি লিমিটেডের প্রতিনিধি নাও কি কুদো।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৫১৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাইকা অর্থায়ন করছে ১ হাজার ১২৩ কোটি টাকা, বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ৩৯৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।
এমআরটি লাইন-১-এর ডিপো এলাকার ভূমি উন্নয়নের জন্য ঠিকাদারও নিয়োগ হয়ে গেছে। প্রকল্পের জন্য নারায়ণগঞ্জের পিতলগঞ্জের মৌজায় ৩৫.৯০ হেক্টর বা ৮৮.৭১ একর ভূমিতে উন্নয়নকাজ করা হবে। এ কাজের ঠিকাদারের দায়িত্ব পেয়েছে জাপানের টকিউ কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড ও বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড।
এমআরটি-১ বিষয়ে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এমআরটি-১ এর প্রায় সব কাজ আমরা গুছিয়ে এনেছি। আগামী বছরের জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে অথবা ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি পেলে এর নির্মাণকাজের উদ্বোধন শুরু করতে পারব বলে আশা রাখি।’
তিনি বলেন, ‘এই এমআরটি-১ আমরা ১২টি প্যাকেজের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করব। এসব প্যাকেজ এখন বিভিন্ন পর্যায়ে আছে। অনেকগুলো এগিয়ে আছে আবার কিছু প্যাকেজ একটু পিছিয়ে আছে। কিছুদিন পরেই আমরা বলতে পারব এই রুটের আন্ডারগ্রাউন্ডের খনন কবে শুরু করা যাবে। তবে আশা করছি এই অর্থবছরের ভিতরেই কাজ শুরু করতে পারব।’
এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি মাটি খননের টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম) আমাদের এখানেই তৈরি করার। তাহলে আমাদের নিজেদের ক্যাপাবিলিটি বাড়বে। খনন কাজটি কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত মাটির নিচে ৩০ মিটার আবার কোথাও কোথাও ৭০ মিটার গভীরে করা হবে।
‘টিবিএম মেশিং যখন মাটির নিচে কাজ করবে তখন রাস্তার উপর থেকে কিছু বোঝা যাবে না। সমস্যা একটু হবে স্টেশন নির্মাণের সময়ে। তবে এই রুটের যে ১২টি স্টেশন থাকবে সেখানে আমরা ওপেন কাট পদ্ধতিতে কাজ করব। স্টেশন এলাকায় সর্বোচ্চ ছয় মাস কাজ চলবে। এ সময় আমরা রাস্তার অর্ধেকটা অংশ চালু রেখে বাকি অর্ধেক অংশে কাজ শেষ করব। পরে এই অংশে মাটি ভরাট করে পরের অংশ ধরব। এমআরটি-৬ এর সময় দীর্ঘ সময় যে ভোগান্তি হয়েছিল সেটি এমআরটি-১ এর সময় হবে না।’
এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, ‘খনন কাজ যেহেতু মাটির ৩০ মিটার নিচে করা হবে সেহেতু এখানে ইউটিলিটি লাইন সরানোরও কোনো প্রয়োজন হবে না। আর স্টেশন এলাকায় আমরা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করব।’
এমআরটি লাইন-৫
এমআরটি লাইন-৫ এর দুটি রুট থাকবে। একটি নর্দান রুট আরেকটি সাউথদান রুট।
নর্দান রুট হলো, হেমায়েতপুর থেকে বলিয়ারপুর, বিলামালিয়া, আমিনবাজার, গাবতলী, দারুস সালাম, মিরপুর ১, মিরপুর ১০, মিরপুর ১৪, কচুক্ষেত, বনানী, গুলশান ২, নতুন বাজার থেকে ভাটারা পর্যন্ত। এর মধ্যে হেমায়েতপুর থেকে আমিনবাজর পর্যন্ত হবে উড়াল রেল আর আমিন বাজার থেকে ভাটারা পর্যন্ত থাকবে পাতাল রেল।
নর্দান রুটে ২০২৮ সালের মধ্যে হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা পর্যন্ত পাতাল ও উড়াল সমন্বয়ে ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেল নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে পাতালপথ ১৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটার এবং ৬ দশমিক ৫০ কিলোমিটার উড়াল মেট্রোরেল হবে। এতে ১৪টি স্টেশন থাকবে, যার মধ্যে ৯টি পাতাল এবং ৫টি উড়াল হবে।
ইতোমধ্যে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ হয়েছে। এখন চলছে বিভিন্ন জরিপ ও মূল নকশার কাজ। মূল নকশা তৈরির কাজের অগ্রগতি ৫০ শতাংশের বেশি।
এমআরটি-৫ এর নর্দান রুটের বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২০৩০ সালের মধ্যে সবগুলো এমআরটি চালু করা আমাদের র্টাগেট। এর মধ্যে আগামী বছরের (২০২৩) জুলাই মাসে এমআরটি-৫ এর নর্দান রুটের কাজ শুরুর জন্য আমরা চেষ্টা করছি।’
এ ছাড়া সাউথদান রুট হলো, গাবতলী থেকে টেকনিক্যাল, কল্যাণপুর, শ্যামলী, কলেজ গেট, আসাদ গেট, রাসেল স্কয়ার, কারওয়ান বাজার, হাতিরঝিল, তেজগাঁও, আফতাব নগর, আফতাব নগর সেন্ট্রাল, আফতাব নগর পূর্ব, নাছিরাবাদ থেকে দাশেরকান্দি পর্যন্ত।
সাউদার্ন রুটে ২০৩০ সালের মধ্যে গাবতলী থেকে দাশেরকান্দি পর্যন্ত ১৭ দশমিক ৪০ কিলোমিটার মেট্রোরেলপথ নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে পাতাল ১২ দশমিক ৮০ কিলোমিটার এবং উড়াল ৪ দশমিক ৬০ কিলোমিটার।
এতে মোট ১৬টি স্টেশন থাকবে, এর মধ্যে ১২টি পাতাল এবং চারটি উড়াল। এই প্রকল্পের প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ হয়েছে। প্রজেক্ট রেডিনেস ফাইনেন্সিংয়ের (পিআরএফ) জন্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সঙ্গে ঋণচুক্তিও সই হয়েছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের কার্যক্রম রয়েছে চূড়ান্ত পর্যায়ে।
ডিএমটিসিএল সূত্র বলছে, এমআরটি-৫ এর দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০২৮ সালের মধ্যে নর্দান রুটের নির্মাণকাজ শেষ হবে। তৃতীয় পর্যায়ে ২০৩০ সালের মধ্যে এমআরটি লাইন-৫ এর সাউদার্ন রুটের কাজ শেষ হবে।
এমআরটি-২ এবং ৪
২০৩০ সালের মধ্যে গাবতলী থেকে চট্টগ্রাম রোড পর্যন্ত উড়াল ও পাতাল সমন্বয়ে প্রায় ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এমআরটি লাইন-২ প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার। এটি বাস্তবায়নে জিটুজি ভিত্তিতে পিপিপি পদ্ধতিতে নির্মাণের লক্ষ্যে জাপান ও বাংলাদেশ সরকার সহযোগিতা স্মারক সই করেছে।
অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর এই প্রকল্পে নীতিগত অনুমোদন দেয়। এমআরটি লাইন-২ এর পিপিপি গবেষণা শেষ করে ২০২০ সালের মার্চে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। এছাড়া পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রথমিক সমীক্ষা করছে, যার অগ্রগতি ৫০ শতাংশ বেশি।
এমআরটি লাইন-৪ এরও নির্মাণকাজও ২০৩০ সালের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য সরকারের। পিপিপি পদ্ধতিতে কমলাপুর-নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে ট্রাকের পাশ দিয়ে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে এই উড়াল মেট্রোরেল।