বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

অনুমোদন নিয়ে চীনামাটির পাহাড় ধ্বংস

  •    
  • ২৭ ডিসেম্বর, ২০২২ ১৩:১১

১৯৬৯ সাল থেকে দেশে চীনা মাটি উত্তোলন শুরু হয়। রাজশাহী, নওগাঁ, দিনাজপুর ও ময়মনসিংহের ধোবাউড়া এবং নেত্রকোনার দুর্গাপুরে পাওয়া যায় এ মাটি। যেকোনো প্রতিষ্ঠান মাটি কাটতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেয়া বাধ্যতামূলক।

বাসনপত্র, বৈদ্যুতিক ইনসুলেটর, স্যানিটারি সরঞ্জাম, কাগজ, কৃত্রিম বস্ত্র ও বিভিন্ন রাসায়নিক শিল্পে ব্যবহার হয় চীনামাটি। গৃহনির্মাণে নান্দনিকতার ছোঁয়া এনে দিয়েছে চীনামাটির তৈরি কারুকাজসংবলিত টাইলস। ফলে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনুমোদন নিয়ে চীনামাটির পাহাড় কাটার নিয়ম থাকলেও তা অমান্য করে ময়মনসিংহের ধোবাউড়ায় ইচ্ছেমতো পাহাড়কাটার মহোৎসব চলছে। এতে ভূপ্রকৃতির চরম বিপর্যয় ঘটছে বলে মনে করেন পরিবেশবাদীরা।

ভারতের মেঘালয় রাজ্যঘেঁষা সীমান্তে ধোবাউড়া উপজেলায় অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি চীনামাটির পাহাড়। উপজেলার পুটিমারি, ভেদিকুড়া, গোসাইপুর এলাকায় রয়েছে এই পাহাড়। কোনো পাহাড় সাদা, কোনোটা হালকা গোলাপি, আবার কোনোটা বাদামি রঙে আচ্ছাদিত। সেখান থেকে চার ধরনের মাটি সংগ্রহ করা হয়। তবে সাদা মাটির পাহাড়ের মাঝে সবুজ পানি পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ে।

গত বছরের ২৬ এপ্রিল 'ছাড়পত্র ছাড়াই কাটা হচ্ছে চীনামাটির পাহাড়' শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে নিউজবাংলা। তুলে ধরা হয় পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই চীনামাটির পাহাড় কাটার চিত্র। এতে টনক নড়ে প্রশাসনের।

সে সময়ের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ এনামুল হকের নির্দেশে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাফিকুজ্জামান জরুরি পদক্ষেপ নিয়ে বন্ধ করেন পাহাড় কেটে মাটি উত্তোলন। পরে ৩০ এপ্রিল 'বন্ধ হলো সেই চীনামাটির পাহাড় কাটা' শিরোনামে আরেকটি সংবাদ প্রকাশ করে নিউজবাংলা। পরপর মাটি কাটতে আর দেখা না গেলেও আবারও প্রকাশ্যে এসেছে নির্বিচারে মাটিকাটা।

বর্তমানে চীনামাটির স্তূপের মধ্যে সাঁটানো হয়েছে সাইনবোর্ড। তাতে লেখা রয়েছে '২০১০ সালে হাইকোর্টে রিট পিটিশনের আদেশ অনুযায়ী বাংলাদেশ অ্যাগ্রো সিরামিক কোম্পানি সাদা মাটি উত্তোলনের কোয়ারি কার্যক্রম ও অপসারণ করছে।'

তার নিচে লেখা 'খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো কর্তৃক প্রদত্ত কোয়ারি ইজারাকৃত প্রতিষ্ঠান মেসার্স অ্যাগ্রো সিরামিক কোম্পানি।' ধোবাউড়া উপজেলার দক্ষিণ মাইজপাড়া ইউনিয়নের ভেদিকুড়া এলাকার ৩ দশমিক ১৭ একর জমিতে চলছে এ কাজ। কোম্পানির মালিক গাজী মো. গোলাম কিবরিয়া তপন।

তবে সূত্র জানায়, ১৯৬৯ সাল থেকে দেশে চীনা মাটি উত্তোলন শুরু হয়। রাজশাহী, নওগাঁ, দিনাজপুর ও ময়মনসিংহের ধোবাউড়া এবং নেত্রকোণার দুর্গাপুরে পাওয়া যায় এ মাটি। যেকোনো প্রতিষ্ঠান মাটি কাটতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেয়া বাধ্যতামূলক।

কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশে ২০১৭ সাল থেকে ছাড়পত্র দেয়া বন্ধ থাকায় দেশের সব চীনামাটির পাহাড় কাটা বন্ধ রয়েছে। তবে ধোবাউড়া উপজেলার ভেদিকুড়া মৌজায় নির্বিচারে চলছে চীনামাটির পাহাড় কাটার মহোৎসব।

স্থানীয়রা জানান, শ্রমিকরা ইচ্ছেমতো মাটি কেটে বিশাল বিশাল গর্তের সৃষ্টি করেছেন। ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে প্রাণ-প্রকৃতি। একসময় দূর-দূরান্ত থেকে প্রচুর দর্শনার্থী এলেও এখন আসে না। মাঝেমধ্যে এক-দুজন এলেও এবড়োখেবড়ো বিশাল গর্তের কারণে হুমকির মুখে পড়ে জীবন। এর আগেও গর্তে পড়ে মানুষ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। সঠিক তদারকি থাকলে যথাযথ নিয়ম মেনেই পাহাড় কাটা হতো।

জহিরুল নামের একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, মাটিকাটার সময় এখানে কোম্পানির মালিককে আসতে দেখা যায় না। প্রশাসনের লোকজনও আসেন না। ফলে মালিকপক্ষের নির্দেশে শ্রমিকরা দেশীয় যন্ত্র দিয়ে ইচ্ছেমতো মাটি উত্তোলন করেন। এতে পাহাড়ের সৌন্দর্য দিন দিন নষ্ট হচ্ছে।

মোফাজ্জল নামের আরেকজন বলেন, চোখ-জুড়ানো অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি চীনামাটির পাহাড়। অথচ কী পরিমাণ মাটিকাটা হবে তার তথ্য স্থানীয় কেউ জানে না। ফলে আমাদের মনে হয় এখানে শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়াই প্রকাশ্যে মাটি উত্তোলন করলেও নিরুপায় এই অধিদপ্তর।

পরিবেশ অধিদপ্তর ময়মনসিংহের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ময়মনসিংহের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) নেতৃত্বে গঠিত সাদা মাটি উত্তোলন ও বিপণনবিষয়ক জেলা মনিটরিং কমিটির মাধ্যমে কোয়ারি এলাকায় স্তূপ করা সাদা মাটি অপসারণ করা হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ অ্যাগ্রো সিরামিকস কোম্পানির ২০১০ সালের রিট পিটিশনের সর্বশেষ অবস্থা এবং এ বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা চেয়ে পরিবেশ অধিপ্তরের পরিচালক (আইন) বরাবর চিঠি দেয় ময়মনসিংহের কার্যালয়। কারণ পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না থাকায় এটি বৈধ প্রতিষ্ঠান নয়।

নির্বিচারে পাহাড় কেটে ভূপ্রকৃতির চরম বিপর্যয় ঘটানো হচ্ছে উল্লেখ করে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক আ শ ম হেফজুল কবির বলেন, সরকারি অনুমোদন নিয়ে পাহাড় কাটলেও ভূপ্রকৃতির কিছুটা হলেও বিপর্যয় ঘটে। আর যদি অনুমোদন না থাকে, তাহলে তো প্রশাসনের তাদারকিও কম থাকে৷ ফলে ইচ্ছেমতো পাহাড় কেটে পরিবেশের ক্ষতি করা হয়। এতে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ে।

পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়ন আন্দোলন ময়মনসিংহের সাধারণ সম্পাদক শিব্বির আহেমদ লিটন বলেন, সাদা মাটি উত্তোলনের বিষয়টি সরকারিভাবে নিষিদ্ধ। পরিবেশ অধিপ্তরের কোনো অনুমোদন না থাকলেও হাইকোর্টের একটি কাগজ সামনে রেখে অবৈধভাবে সাদা মাটির পাহাড় কাটা হচ্ছে। ফলে কোম্পানি লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে মেসার্স অ্যাগ্রো সিরামিক কোম্পানির মালিক গাজী মো. গোলাম কিবরিয়া তপনের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল দিলেও ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। নিউজবাংলার পরিচয় দিয়ে এসএমএস দিলেও সারা পাওয়া যায়নি।

পরিবেশ অধিদপ্তরের ময়মনসিংহের উপপরিচালক মিহির লাল সরদার বলেন, কোম্পানিটি হয়তো খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে মাটি কাটার কাজ করছে। যেহেতু পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই, তাই এটি বৈধ প্রতিষ্ঠান নয়। বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছি। যে সিদ্ধান্ত আসবে, সেভাবেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ময়মনসিংহের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) পারভেজুর রহমান বলেন, চীনা মাটি কাটা নিয়ে আদালতের একটি রিট আছে। তবে সেখানে উত্তোলনে তাদের কোনো অনুমতি নেই। ইতোমধ্যে মাটি কাটার বিষয়টি নিয়ে ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় ইউএনওকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

ধোবাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফৌজিয়া নাজনিন বলেন, চীনামাটি উত্তোলনের বিষয়টি জানা ছিল না। খোঁজখবর নিয়ে মাটি কাটার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এ বিষয়ে খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর উপপরিচালক মামুনুর রশীদ বলেন, পরিবেশের ছাড়পত্র না দেয়ার কারণেই মামলাটি করা হয়েছিল। আদালতের অনুমতি নিয়েই সাদা মাটি উত্তোলন চলছে।

এ বিভাগের আরো খবর