দুই কন্যা শিশুর অভিভাবকত্বের অধিকার নিয়ে জাপানি মা নাকানো এরিকো এবং বাংলাদেশি বাবা ইমরান শরীফ ফের প্রকাশ্য বিরোধে জড়িয়েছেন। তারা পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ তুলেছেন একে অন্যের বিরুদ্ধে।
বাবা ইমরান শরীফের দাবি, দুই কন্যা নিয়ে জাপানে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন নাকানো এরিকো। এর মাধ্যমে তিনি আদালত অবমাননা করেছেন।
মা নাকানো এরিকোর দাবি, এক কন্যাকে ছিনতাই করে নিয়ে গেছেন বাবা ইমরান শরীফ। নির্ধারিত সময় ও স্থানের বাইরে কন্যাকে নিয়ে গিয়ে তিনি ক্রমাগত আদালতের আদেশ অমান্য করছেন।
সোমবার পৃথক সংবাদ সম্মেলনে তারা বিস্তর অভিযোগ করেন একে অন্যের বিরুদ্ধে।
নাকানো এরিকো তার আইনজীবী শিশির মনিরের ধানমন্ডির চেম্বারে সংবাদ সম্মেলন করেন।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আমি অসহায় জাপানি মা। আমি কঠিন সময়ের মুখোমুখি। ইমরান শরীফ গত ২৩ ডিসেম্বর রাতে আমার ছোট মেয়ে লাইলা লিনাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছেন। আমি তার হদিস জানি না। বারবার ই-মেইল করেও জবাব পাচ্ছিনা।’
জাপান যাওয়ার চেষ্টা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার মা ৭৬ বছর বয়সী, সম্প্রতি তার স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে। জাপানের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মাকে দেখতে যেতে চাই। সেখানে আমার তৃতীয় মেয়ে সোনিয়া কার্যত একা।
এখন বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট এবং পারিবারিক আদালতে ছুটি চলছে। আমার পারিবারিক মামলার পরবর্তী তারিখ ১১ জানুয়ারি। এ অবস্থায় মৌখিকভাবে ইমরান শরীফের সাথে বিষয়টি শেয়ার করেছি। আমি মেয়েদের নিয়ে জাপান যেতে চাই এবং ১০ জানুয়ারির মধ্যে ফিরে আসব বলে তাকে জানিয়েছি।’
নাকানো এরিকো বলেন, ‘১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ৩ (তিন) মাসের মধ্যে মামলাটি শেষ করার নির্দেশ দিয়েছিল পারিবারিক আদালতকে। কিন্তু ইমরান বিলম্ব করায় প্রায় এক বছর ধরে বিচার চলছে। অসুস্থ মা এবং তৃতীয় মেয়ে সোনিয়াকে দেখতে আমার জাপান যাওয়া জরুরি।
‘ইমরান আমার ব্যক্তিগত জীবন পর্যবেক্ষণ করতে বেশ কিছু গুপ্তচর রেখেছেন। বিষয়টি থানা ও পারিবারিক আদালতকে জানালে তারাও এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেনি। ইমরান আমার ড্রাইভার, অনুবাদক, বন্ধু এবং আইনজীবীর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। এমনকি আমার বাসার রিয়েল এস্টেট ম্যানেজারকে হুমকি দিয়েছেন। বেশ কয়েকবার আমাকে প্রকাশ্যে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিতও করেছেন।’
সন্তানসহ বিমানবন্দর থেকে ফিরছেন জাপানি নারী নাকানো এরিকো। ছবি: নিউজবাংলা
সুপ্রিমকোর্টের এনেক্স ভবনের সামনে পৃথক সংবাদ সম্মেলনে ইমরান শরীফ পাল্টা অভিযোগ তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, ‘এরিকো আমার দুই কন্যা নিয়ে আদালতের আদেশ অমান্য করে জাপানে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। আমি খবর পেয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খুব অল্প সময়েই সেখানে পৌঁছে যাই। তখন এক মেয়ে আমার কাছে ছুটে চলে আসে। মেয়ে লাইলা লিনা আমার কাছেই আছে।
‘আমি কেন নিজের মেয়েকে ছিনতাই করবো? আমার মেয়েকে জাপানে নিয়ে গেলে তো আমি তাদের ফেরত পাব না। আমার তিনটা মেয়ে, ছোট মেয়েটা তো এখন জাপানে আছে। দেড় বছর আমার সঙ্গে তাকে কথা বলতে দেয়া হয়নি। এরিকো আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে দুই কন্যা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন, বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে ইমরান শরীফ বলেন, ‘এরিকো বাচ্চাদের জীবন থেকে বাবার নাম মুছে ফেলার চেষ্টা করছেন। তা না করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কন্যারা তার মায়ের কাছে নিরাপদ নয়, তাদের অন্যের বাসায় রেখে সম্প্রতি ভারত ঘুরে এসেছেন।’
সম্প্রতি এ দম্পতির বড় কন্যা জেসমিন মালিকার হাতে লেখা একটি চিঠি গণমাধ্যমে এসেছে। যেখানে বড় কন্যা জেসমিন লিখেছেন, ‘আমরা জাপানে ফিরে যেতে চাই। আমরা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে চাই। আমাদের নানীকে দেখতে চাই। জাপানে গিয়ে লেখাপড়া করতে চাই।’
২০০৮ সালের ১১ জুলাই জাপানের এরিকো ও বাংলাদেশি আমেরিকান শরীফ ইমরান বিয়ে করেন জাপানি আইন অনুযায়ী। এরিকো পেশায় একজন চিকিৎসক। বিয়ের পর তারা টোকিওতে বাসবাস শুরু করেন। তাদের ১২ বছরের সংসারে তিন মেয়ে সন্তানের জন্ম দেন এরিকো। তারা হলো জেসমিন মালিকা, লাইলা লিনা ও সানিয়া হেনা। তাদের কন্যারা টোকিওর চফো সিটিতে আমেরিকান স্কুল ইন জাপানের (এএসআইজে) শিক্ষার্থী ছিল।
গত বছরের ১৮ জানুয়ারি শরীফ ইমরান বিয়েবিচ্ছেদের (ডিভোর্স) আবেদন করেন। ২১ জানুয়ারি ইমরান এএসআইজে স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে তার মেয়ে জেসমিন মালিকাকে নিয়ে যাওয়ার আবেদন করেন। স্কুল কর্তৃপক্ষ মা এরিকোর সম্মতি না থাকায় তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। পরে ইমরান তার মেয়ে জেসমিন ও লিনাকে স্কুলবাসে বাড়ি ফেরার পথে বাসস্টপ থেকে অন্য একটি ভাড়া বাসায় নিয়ে যান।
২৫ জানুয়ারি ইমরান তার আইনজীবীর মাধ্যমে এরিকোর কাছে তার সন্তানদের পাসপোর্ট হস্তান্তরের আবেদন করেন। এরিকো তা প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর ২৮ জানুয়ারি এরিকো টোকিওর পারিবারিক আদালতে তার সন্তানদের জিম্মার অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ চেয়ে মামলা করেন। আদালত ৭, ১১ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি শিশুদের সঙ্গে পারিবারিকভাবে সাক্ষাতের আদেশ দেয়। ইমরান আদালতের আদেশ ভঙ্গ করে মাত্র একবার মায়ের সঙ্গে দুই মেয়ের সাক্ষাতের সুযোগ দেন।
এরিকোর অভিযোগ, গত বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে ইমরান তার মেয়েদের জন্য নতুন পাসপোর্টের আবেদন করেন এবং গত ১৭ ফেব্রুয়ারি নতুন পাসপোর্ট নেন। গত ২১ ফেব্রুয়ারি ইমরান তার দুই মেয়ে জেসমিন ও লাইলাকে নিয়ে দুবাই হয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন।
এরপর মা এরিকো বাংলাদেশে এসে মামলা করেন এবং সন্তানের খোঁজ চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন। বিষয়টি গড়ায় দেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগ পর্যন্ত। আপিল বিভাগ ৩ মাসের মধ্যে মামলাটি নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন বিচারিক আদালতকে। মামলা বিচারাধীন থাকা অবস্থায় গত ২৩ ডিসেম্বর দুই কন্যাকে নিয়ে মা নাকানো এরিকো জাপানে যেতে চাইলে আটকে যান বিমানবন্দরে।