প্রতিদিন শ্রীমঙ্গলের ৬ থেকে ৮ লাখ লেবু বাজার থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেত। দামও ছিল ভালো। কিন্তু হঠাৎ করেই তা নেমে এসেছে ৩ থেকে ৪ লাখে। লেবুর দামও কমেছে দুই থেকে তিন গুণ। গত বছর এই সময়ে লেবুর দাম ছিল ২ থেকে ৪ টাকা, কিন্তু চলতি বছরে এই সময়ে লেবুর দাম নেমে এসেছে ৫০ পয়সা থেকে দেড় টাকায়। ফলে মাথায় হাত পড়েছে লেবু চাষি ও ব্যবসায়ীদের।
ভারতীয় লেবু বাজারে আসা এবং চট্টগ্রাম, কাপাশিয়া, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লেবু চাষের ফলে শ্রীমঙ্গলের লেবু বাজারে সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
তারা বলছেন, চাষিরা লেবু বিক্রি করতে এসে লসে পড়ছেন। দাম না পেয়ে অনেকে লেবু ফেলে দিচ্ছেন।
লেবু ব্যবসায়ী সমিতির তথ্য মতে, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থেকে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল হয়ে কমলগঞ্জ পর্যন্ত এবং আশপাশের পাহাড়ি এলাকায় দুই হাজার লেবুর বাগান রয়েছে।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জসহ ৭ উপজেলা ও হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের পাহাড়-টিলার মাটি ও আবহাওয়া দুটিই লেবু চাষের উপযোগী। প্রতি মৌসুমে বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপক কাগজি, চায়না, জারা, পাতি ও কাটা লেবুর উৎপাদন হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, শুধু মৌলভীবাজারে ১ হাজার ৫২০ হেক্টর জমিতে লেবু চাষ হয়, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাষ হয় শ্রীমঙ্গলে।
শ্রীমঙ্গলের পাইকারি বাজার থেকে লেবু নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায়।
চাষিরা বলছেন, এ বছরের প্রথম দিকে বিরূপ আবহাওয়ায় লেবু বাগানের কিছু ক্ষতি হলেও ফলন ভালোই হয়েছে। প্রত্যন্ত জনপদের চাষিরা বিক্রির জন্য লেবু নিয়ে আসতেন বাজারে। আর করোনায় লেবুর বাড়তি চাহিদা থাকায় কাকডাকা ভোরে শুরু হতো লেবুর ব্যবসা। চাহিদাও ছিল তুঙ্গে, কিন্তু বছরের শেষ সময়ে এসে সে চিত্র বদলে গেছে।
চাষের খরচ তুলতে পারছেন না চাষিরাশ্রীমঙ্গলের সীমান্তঘেঁষা শিবির বাড়ি খাস এলাকার লেবু চাষি লিটন মিয়া। তিনি বলেন, গাছ থেকে এক গাড়ি (২ হাজার পিস) লেবু পাড়তে মজুরি দিতে হয় ৭৫০ টাকা, বাজারে নিয়ে যেতে গাড়িভাড়া ১,২০০ টাকা। আমার এক গাড়ি লেবু বাজারে তুলতে মোট খরচ হয় ১,৭৫০ টাকা। কিন্তু কোনো লাভ হয় না। এক দিন ২০০ টাকা লাভ হলে পরের দিনেই ১০০ টাকা লস। এতে লেবু চাষে আর উৎসাহ পাচ্ছি না। অনেক চাষি লেবু পেড়ে ফেলে দিচ্ছেন।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় লেবু চাষ হওয়ায় চাহিদা কমেছে মৌলভীবাজারের লেবুর। ছবি নিউজবাংলা
লেবু চাষিরা জানান, একসময় সেপ্টেম্বরে লেবুর সিজন শেষ হয়ে যেত, তবে বর্তমানে সারা বছর লেবু থাকে। এখন উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগ ও উচ্চ ফলনশীল চারা রোপণের কারণে সারা বছরই লেবু উৎপাদন হচ্ছে।
লেবু চাষি সামছুল হক জানান, তিনি এই বছর ৩০ একর জমিতে লেবু চাষ করেছেন। কিন্তু লেবু বিক্রি করে চাষের খরচ তুলতে পারছেন না।
এভাবে লস দিয়ে ব্যবসা বেশিদিন চালানো কঠিন বলে জানান তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ব্যবসায়ীর অভিযোগ, ভারত থেকে প্রচুর লেবু বাজারে ঢুকছে। যার ফলে লেবুর বাজারে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। এমনিতেই লেবুর দাম কম, তার ওপর ভারতীয় লেবু বাজারে আসায় দাম আরও কমছে।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় হচ্ছে লেবু চাষশ্রীমঙ্গল লেবু ঘরের পরিচালক আশুতোষ চক্রবর্তী জানান, এই বছর হঠাৎ লেবুর বাজারে এই পরিবর্তন এসেছে। মূলত দেশের বিভিন্ন জায়গায় লেবুর চাষ বেড়েছে। আগে যেভাবে সারা দেশের লেবুর চাহিদা পূরণ করত শ্রীমঙ্গল এখন আর সেভাবে নেই। শ্রীমঙ্গলের লেবু না গেলেও চাহিদা পূরণ হবে অনান্য এলাকার লেবু থেকে। তাই দাম কমে গেছে।
শ্রীমঙ্গল আড়ত ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. জসিম জানান, এবার লেবুর দাম গত বছরের তুলনায় তিন গুণ কম। ফলে চাষিরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তেমনি লেবু ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ জানান, এই জেলার মাটি ও আবহাওয়া লেবু চাষের জন্য উন্নত। জেলায় ১৫০০ থেকে ২০০০ হেক্টর জমিতে এ বছর লেবু চাষ হয়েছে। কৃষকদের তারা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছেন। বাজারদর ওঠানামা করা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, তবে চাষিরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সে ব্যাপারে তারা খেয়াল রেখে সব ধরনের ব্যবস্থা নেবেন।
ভারত থেকে স্থানীয় বাজারে লেবু আসার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে এই রকম অভিযোগ আসেনি। যদি অভিযোগ পাই তাহলে বিজিবিসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’