প্রায় পনেরো বছর আগে অষ্টাদশী তরুণী আফরোজা বেগমের সঙ্গে বিয়ে হয় পঞ্চগড় সদর উপজেলার মীরগড় গ্রামের জাহের আলীর। স্থানীয় মীরগড় বাজারে চা-দোকান পরিচালনা করেন তার স্বামী। ডালের বড়া, পেঁয়াজু, বুন্দিয়া কখনও কখনও জিলাপিও বিক্রি করেন জাহের আলী।
আফরোজার শ্বশুর আজিজুল হক একই বাজারে একটি ছোট্ট দোকানে চালের গুঁড়ো, ময়দা, চিনি অথবা গুড় মিশিয়ে বিশেষ মিষ্টান্ন টোপা তৈরি করে বিক্রি করেন। স্থানীয় বাজারে বিশেষভাবে তৈরি এই মিষ্টান্নের বেশ কদর।
একই সঙ্গে বেড়াতে আসা লোকজনের কাছেও বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠা টোপার চাহিদা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে।
অল্প পুঁজি খাটিয়ে বেশ লাভ হওয়ায় শ্বশুরের বিশেষ সেই মিষ্টান্ন তৈরির কৌশল শিখে আফরোজা নিজেই তৈরি করেন মজাদার মিষ্টান্ন টোপা। সংসারের কাজের ফাঁকে তিনি বাড়িতেই তৈরি করেন এই মিষ্টান্ন। এতে তিনিও দেখেন লাভের মুখ।
নিজের তৈরি করা টোপা স্বামীর দোকানে বিক্রি করে তাদের পরিবারে এসেছে আর্থিক সচ্ছলতা। এমনটি জানালেন ৩৩ বছর বয়সী আফরোজা বেগম।
আজিজুল হক বলেন, ‘প্রায় শত বছর আগে আন্ধারী বেগম নামের এক নারী মীরগড়ে এসে বিশেষ এই মিষ্টান্ন তৈরি করে বাড়ি বাড়ি ফেরি করে বিক্রি করতেন। খেতে মজাদার হওয়ায় গ্রামের যে প্রান্তেই যেত সেখানেই তা বিক্রি হয়ে যেত। সেই থেকে এখন পর্যন্ত সমান চাহিদা ধরে রেখেছে ঐতিহ্যবাহী এই মিষ্টান্নটি। তবে বর্তমানে চিনি ময়দা এবং তেলের দাম বাড়ার কারণে দোকানিরা পড়েছেন বিপাকে।’
স্থানীয়রা বলছেন, পঞ্চগড়ের মীরগড়ে অতিথি আপ্যায়ন আর বন্ধুদের চা-চক্রের আড্ডায় মিষ্টান্ন হিসেবে টোপা বেশ জনপ্রিয় একটি খাবার। চালের গুঁড়ো, ময়দা, চিনি অথবা গুড় দিয়ে স্থানীয়ভাবে তৈরি রসালো মিষ্টান্ন টোপা এখন স্থানীয় মানুষের রসনা বিলাসের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে যাচ্ছে লোকজন।
এ ছাড়া স্কুল-কলেজের টিফিন সময়ে শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয় এই মিষ্টান্নটি খাওয়া যেন রুটিনে পরিণত হয়েছে। কৃত্রিম কোনো রং বা কেমিক্যাল না মিশিয়ে চালের গুঁড়ো অথবা ময়দা দিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি রসালো টোপা চিনি বা গুড়ের সিরায় ভিজিয়ে তৈরি করা হয়। দামেও বেশ সস্তা হওয়ায় ক্রেতার কাছে চাহিদাও বেশ।
বাজারের কোল ঘেঁষে থাকা মীরগড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একই ক্যাম্পাসে থাকা মীরগড় ময়নউদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয়। দুপুরে টিফিনের ফাঁকে শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই আসে জাহের আলীর চায়ের দোকানে। স্কুলশিক্ষার্থী মাইশা ও রাইসা অন্বেষা বলে, ‘টিফিনে টোপা খেতে বেশ ভালোই লাগে। স্কুলের অনেক শিক্ষার্থীর কাছে টোপা বেশ প্রিয়।’
স্কুলশিক্ষক নূর আজম বলেন, ‘অতিথি আপ্যায়ন আর নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত মিষ্টান্ন টোপা খেতে যতটা মজার একইভাবে বন্ধু বা আত্মীয়দের মাঝে পরিবেশন করেও আনন্দ পাওয়া যায়।’
মীরগড়ের বাসিন্দা পঞ্চগড় জেলা আইনজীবী সমিতির সিনিয়র আইনজীবী আহসান হাবিব বলেন, ‘মীরগড়ের এই টোপা পঞ্চগড়ের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। বিশেষত্বের কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত পর্যটকরা টোপার স্বাদ নিতে মীরগড়ে আসেন।’
মীরগড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আতাউর বলেন, ‘টোপায় কৃত্রিম কোনো রং ও ক্ষতিকর কোনো কেমিক্যালের মিশ্রণ না থাকায় এই মিষ্টান্ন অন্যান্য খাবারের তুলনায় নিরাপদ। বিশেষ করে শিশুদের জন্য মুখরোচক খাবার এটি।’
ধাক্কামারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম দুলাল বলেন, ‘শত বছর ধরে মীরগড়ের রসালো মিষ্টান্ন টোপা স্থানীয়দের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা লোকজনের রসনা বিলাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।’