বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সেই বিভীষিকার রাত: কেউ সাজা পায়নি

  •    
  • ২৪ ডিসেম্বর, ২০২২ ১৪:২৬

এক বছর আগে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে একটি লঞ্চ আগুনে পুড়ে যায়। সেই বিভীষিকার কথা স্মরণ করে আজও অনেকে শিউরে ওঠেন। নৌ আদালতে মামলা হয়েছিল। কারাগারে থাকা লঞ্চের মালিক মো. হামজালাল শেখসহ সব আসামি জামিনে মুক্ত হন।

সপ্তাহের শেষ দিন হওয়ায় পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে দক্ষিণ জনপদের উদ্দেশে যাচ্ছিলেন অনেকে। রাত ৩টা ৫০ মিনিট। নদীর বুকে শত শত মানুষের বাঁচার আকুতি দুপাড়ের মানুষের ঘুম ভাঙিয়ে দেয়।

ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে ‘এমভি অভিযান-১০’ লঞ্চে গত বছর এই দিনে ঘটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। আগুনে দগ্ধ হয়ে নারী-শিশুসহ অর্ধশত মানুষের মৃত্যু ঘটে, আহত হয় শতাধিক।

গত বছর ২৩ নভেম্বর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর সদরঘাট থেকে কয়েক শ যাত্রী নিয়ে লঞ্চটি বরগুনার উদ্দেশে ছেড়ে আসে।

মাঝনদীতে লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে অসহায় মানুষের চিৎকার শুনে ঘর থেকে বের হয়ে আসেন ঝালকাঠি সদর উপজেলার পোনাবালিয়া ইউনিয়নের দিয়াকুল গ্রামের নদীর তীরবর্তী বাসিন্দারা। সেই রাতে আগুনে পোড়া শত শত মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিলেন গ্রামবাসী। সেদিনের কথা মনে হলে আজও শিউরে ওঠেন তারা।

নিউজবাংলার কাছে বিভীষিকাময় সেই রাতের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে দিয়াকুল গ্রামের শিরিন আক্তার বলেন, "রাত সাড়ে ৩টার পরে 'আগুন, আগুন' বলে নদীর তীরে মানুষের চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙে যায়। ঘর থেকে বের হয়ে দেখি উত্তর দিকের (নদীর দিক) আকাশ লাল। কুয়াশার ভেতর প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে পারিনি। একটু সামনে গিয়ে দেখি নদীর মধ্যে যাত্রীবাহী একটি লঞ্চে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে।

"অনেক মানুষ সাঁতার কেটে কুলে আসতেছে। সবাই বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছে। লঞ্চটা ভাসতে ভাসতে একেবারে পাড়ে চলে আসছে। আগুনের তাপ এতটাই বেশি ছিল আমরা তখন নদীর তীরে দাঁড়াতে পারছিলাম না। একে একে উদ্ধার করি নারী-শিশুসহ প্রায় ৩০০ মানুষকে। ১৩টি ঘরে তাদের আশ্রয় দিই।"

একই গ্রামের আবুল হোসেন বলেন, ‘একদিকে আগুনে পোড়া মানুষগুলো যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, অপরদিকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে আসা মানুষেরা শীতে জ্ঞান হারাচ্ছে। সবাইকে শুকনা জামাকাপড় দিই, কম্বল দিই, পোড়া মানুষদের ট্রলারে উঠিয়ে হাসপাতালে পাঠাই।’

ওই সময়ে লঞ্চে থাকা যাত্রী অ্যাডভোকেট আশিক আহম্মেদ বলেন, ‘লঞ্চের ভেতর আগুন যে তাণ্ডব চালিয়েছে, তা ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়। তিনতলা জাহাজের পুরোটাই আগুনে পুড়ে ভস্ম হয়ে গেছে। রাত ৩টায় ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় এবং জেনারেটর বন্ধ হয়ে পুরো লঞ্চ অন্ধকার হয়ে যায়। আমি ও আমার দুই বন্ধু মীর ফায়াজ এবং রাইসুল আকরাম তখন তৃতীয় তলায় ৩০৩ নম্বর কেবিনে ছিলাম।

‘বের হয়ে দেখি মাস্টার ব্রিজ ফাঁকা। লঞ্চের মাস্টার, সুকানি কেউ নেই। তখন লাল আগুন ওপরে উঠতে থাকে। আমরা তিনতলা থেকেই নদীতে ঝাঁপ দিই। ৮ থেকে ১০ মিনিট সাঁতার কাটি। এরপর নদীর কিনারা পাই। জায়গাটি ঝালকাঠির দিয়াকুল গ্রাম। সেখানকার আকন বাড়িতে আমাদের নিয়ে যায় লোকজনেরা।’

স্থানীয় কাঠমিস্ত্রি রাজু বলেন, ‘ওই দিন রাতে আমি কমপক্ষে ৩৫ জনকে লঞ্চ থেকে বের করে অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়েছি। এদের অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানোর সময় আমার শরীরে তাদের পুড়ে যাওয়া মাংস লেগে যাচ্ছিল।’

ঝালকাঠি পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. হুমায়ুন কবির সাগর বলেন, ‘ভোর রাতে ২৪ জন কর্মী ও চারটি ট্রলার নিয়ে লঞ্চের দেড় শ যাত্রী উদ্ধার করেছি আমি। সেই রাতে লঞ্চে আগুন দেখে এলাকার ছোট ভাইদের নিয়ে চারটি ট্রলারে করে লঞ্চের দিকে যাই। কিন্তু তাপের কারণে লঞ্চের কাছে যেতে পারছিলাম না। এরই মধ্যে অনেক যাত্রী নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ট্রলারের দিকে সাঁতরে আসেন। এভাবে দেড় শ যাত্রীকে আমরা তীরে নিয়ে আসি।

‘ভোর সাড়ে ৪টা নাগাদ ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা এলে তাদের লোকবল ও ট্রলার দিয়ে সহযোগিতা করে আরও অনেক যাত্রী এবং তিনটি মরদেহ উদ্ধার করি। সূর্য ওঠার পর পুলিশ ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কর্মীরা উদ্ধারকাজে অংশ নেন।’

ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া কর্মকর্তা মো. রায়হান নিউজবাংলাকে জানান, ‘রাত ৩টা ২৮ মিনিটে আমরা খবর পাই। ৩টা ৫০ মিনিটে ১৫টি ইউনিট আগুন নেভানো শুরু করে। সাড়ে ৫টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।’

ঘটনার দুই দিন পর ২৭ ডিসেম্বর নৌপরিবহন অধিদপ্তর দুর্ঘটনার কারণ তদন্তে অধিদপ্তরের জাহাজ জরিপকারক ও পরীক্ষক প্রকৌশলী মো. আরাফাত হোসেনকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল।

একই দিন রাতে (২৭ ডিসেম্বর) লঞ্চটিতে অগ্নিকাণ্ড ও প্রাণহানির ঘটনায় ঝালকাঠি সদর থানায় একটি মামলা করেন লঞ্চের নিখোঁজ যাত্রীর স্বজন ঢাকার ডেমরা এলাকার বাসিন্দা মো. মনির হোসেন।

মামলায় যাদের আসামি করা হয়, তারা হলেন অভিযান-১০ লঞ্চের মালিক হামজালাল শেখ, লঞ্চে থাকা দুই মাস্টার রিয়াজ সিকদার ও মো. খলিল, দুই ড্রাইভার মো. মাসুম ও কালাম, সুপারভাইজার মো. আনোয়ার, সুকানি আহসান এবং লঞ্চের কেরানি কামরুল ইসলাম। ঝালকাঠি আদালত মামলাটি ঢাকার নৌ আদালতে স্থানান্তর করে।

২০২২ সালের ২৫ জানুয়ারি নৌ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় চার সদস্যের তদন্ত কমিটি। তারা ২৫টি সুপারিশ, মতামতসহ প্রতিবেদন জমা দেয়। তবে লঞ্চের মালিক ও মাস্টার-ড্রাইভারদের হতাহতের দায় দিলেও সরকারি কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ দায় নির্ধারণ করেনি এই কমিটি। তবে ওই সময়ে ঢাকা সদরঘাটের জাহাজ জরিপকারক মাহবুবুর রশিদকে বদলি করে নৌ অধিদপ্তর।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নৌ আদালতের মামলায় কারাগারে থাকা লঞ্চের মালিক মো. হামজালাল শেখসহ সব আসামি জামিনে মুক্ত হন। নৌ আদালতের বিচারক স্পেশাল মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জয়নাব বেগম তাদের জামিনের আদেশ দেন। জামিনের পর লঞ্চমালিক হামজালাল ঝালকাঠি এসে থানায় জব্দ করা পোড়া লঞ্চটি নিজের জিম্মায় ঢাকায় নিয়ে যান।

ঘটনার পর বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, মেরিন ইঞ্জিনিয়ার মিহির বিশ্বাস পুড়ে যাওয়া লঞ্চটি পরিদর্শনে এসে বলেছিলেন, ‘লঞ্চটির ইঞ্জিনসহ যাবতীয় কাঠামোতেই গলদ ছিল, যে কারণে গোটা লঞ্চটি আগুনে পুড়েছে। লঞ্চটির অবকাঠামো যদি গুণগত মান বজায় রেখে নির্মাণ করা হতো, তবে আগুন লাগলেও এতটা তাণ্ডব ঘটার সুযোগ থাকত না।

‘যেমন লঞ্চের ইঞ্জিন রুম পুরোটাই সুরক্ষিত থাকার কথা, কিন্তু এই লঞ্চটির ইঞ্জিন রুম সুরক্ষিত নয়, বাইরে থেকে ইঞ্জিন রুমের ভেতর দেখা যায়, নিয়ম অনুযায়ী এমন হওয়ার কথা ছিল না। ইঞ্জিন রুম সুরক্ষিত ছিল না বলেই আগুন দ্রুত বাইরে ছড়িয়ে যায়। লঞ্চের ফার্নিচারগুলো ফায়ারপ্রুফ না হওয়ায় সেগুলোতে দ্রুত আগুন জ্বলে ওঠে।’

নদী নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘নোঙর’-এর সভাপতি সুমন শামস এ ঘটনার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে নিউজবাংলকে বলেন, ‘এ ঘটনাকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলা যায়। এই লঞ্চ ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা ও তদারকির সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের অবহেলা ও অনিয়মের কারণে এ ঘটনা ঘটেছে। কেননা, একটি লঞ্চ চলাচলের জন্য যে ধরনের ব্যবস্থাপনা এবং নিয়মকানুন মেনে চলার কথা, লঞ্চটিতে তার কিছুই ছিল না। লঞ্চের বিভিন্ন স্থানে তালামারা ছিল। আমার মনে হচ্ছে, ওই সময় ওইখানে যারা ছিল, তারা তালা ভেঙে বেরোতে পারেনি এবং সেখানেই পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে।’

লঞ্চের নিচ ও দ্বিতীয় তলার কিছু অংশ ছিল ডেকের যাত্রীদের জন্য। আর দ্বিতীয় তলার অর্ধেক অংশ এবং তৃতীয় তলার পুরোটাই ছিল কেবিন যাত্রীদের জন্য।

অভিযান-১০ লঞ্চে সিঙ্গেল ও ডাবল মিলিয়ে শতাধিক কেবিন ছিল। এসব কেবিনে পাঁচতারকা মানের হোটেলের মতো সব ধরনের আয়োজনও ছিল। শুধু ছিল না পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ও জরুরি মুহূর্তে পানিতে লাফিয়ে জীবন বাঁচানোর বয়া।

ডেকের যাত্রীদের জন্য নিচ ও দ্বিতীয় তলায় ৫০টিরও কম বয়া ছিল। দ্বিতীয় তলার কেবিনের দুই পাশ মিলিয়ে ৮ থেকে ১০টি বয়া রাখার স্থান ছিল আর তৃতীয় তলায় ৫৮টি সিঙ্গেল ও ডাবল কেবিনের জন্য সব মিলিয়ে ২০টি বয়া রাখার স্থান ছিল। অর্থাৎ শতাধিক কেবিনের জন্য মাত্র ৩০টি বয়া রাখার স্থানের চিহ্ন পাওয়া গেছে। আবার বয়াগুলো রাখা ছিল অন্তত ১২ ফুট উচ্চতায়। তা-ও আবার রশি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা, যা ছিল যাত্রীদের নাগালের বাইরে।

এ বিভাগের আরো খবর